নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শনিবার,

২০ এপ্রিল ২০২৪

অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় পাগলা উচ্চ বিদ্যালয়, সুরাহা নেই

নারায়ণগঞ্জ টাইমস

প্রকাশিত:০০:০৫, ১৩ জুন ২০২২

অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় পাগলা উচ্চ বিদ্যালয়, সুরাহা নেই

অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও যৌন হয়রানির একের পর এক অভিযোগে ডুবতে বসেছে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কুতুবপুরের পাগলা উচ্চ বিদ্যালয়।

 

স্কুলটি নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনায় আলোচনায় উঠে এলেও হচ্ছে না কোনো সুরাহা। বরং আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ আসছে বারবার।

 
এবার এই স্কুলেরই ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সদস্য জাহের মোল্লা যেন হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন। স্কুলটির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাঁর দেওয়া স্ট্যাটাস রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে। 


একাধিক সূত্র জানায়, জাহের মোল্লা দীর্ঘদিন ধরে পাগলা উচ্চ বিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সরব রয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল শুক্রবার (১১ জুন) এক স্ট্যাটাসে তিনি বিদ্যালয়টিতে কীভাবে দুর্নীতি হচ্ছে এর একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজ আইডিতে তুলে ধরে পোস্ট করেন।  


বিভিন্ন খাত থেকে স্কুলের বার্ষিক আয় হচ্ছে ২ কোটি ৯৩ লক্ষ বিশ হাজার টাকা, এমন হিসেব তুলে ধরে তিনি আফসোস করে লিখেন, 'কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষক জানালেন  তাদের তিন মাসের বেতন বাকি আছে। তাই বাধ্য হয়ে চাপ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশনি করান। আরও জানা গেছে স্কুল ফান্ডে কোন টাকা নেই। তাহলে টাকা গেল কোথায়।


তাছাড়া বিদ্যালয়ের সব কয়টি বিল্ডিং মাননীয় এমপি মহোদয় ডিউ লেটার এর মাধ্যমে সরকারি অনুদানে করে দিয়েছেন। স্কুলের টাকায় কোন নির্মাণ কাজ হয়নি। বর্তমানে আরেকটি বিল্ডিং নির্মাণাধীন এইটি ও মাননীয় এমপি মহোদয় করে দিয়েছেন দিয়েছেন।


এইজন্য আমরা বৃহত্তর পাগলা বাসি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ । তিন চার মাস যাবত কেন শিক্ষক  এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা বেতন পায় না। স্কুলের শিক্ষকদের কোচিংয়ের বিষয়টি নিয়ে ও লিখেন। এ সকল বিষয়ে মাননীয় এমপি মহোদয়ের দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।


জাহের মোল্লার ওই স্ট্যাটাস প্রকাশ্যে আসতেই ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মন্তব্যের ঘরে অনেককেই জাহের মোল্লাকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, অর্থ আত্মসাৎকারী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেন। 


কেউ কেউ স্কুলটির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷ মন্তব্যকারীদের মধ্যে অনেকেই দুর্নীতিবাজ চক্রের বিভিন্ন অপকর্মের বর্ণনা দেন৷ সবমিলিয়ে ভাইরাল ওই স্ট্যাটাস কুতুবপুরের টক অব দ্য ইউনিয়নে পরিণত হয়। 


আর এই ধাক্কা সামলাতে স্কুলের এডহক কমিটির একমাত্র সদস্য ও  বহুল সমালোচিত বিতর্কিত সকল অপকর্মের মূল অভিযুক্ত রেজাউল করিম আজ শনিবার (১২ জুন) স্কুলেই তড়িঘড়ি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন৷ সেখানে তিনি স্কুলের আয়-ব্যয়ের একটি হিসেব পড়ে শোনান৷ একই সাথে প্রতিবাদী হিসেবে পরিচিত জাহের মোল্লা কে বিতর্কিত করার চেস্টা করায় লিপ্ত থাকেন। 


যদিও সেটিকে অসামঞ্জস্যতায় ঠাসা বলছেন উপস্থিত অনেকেই। এমনকি ওই হিসেব সেখানে উপস্থিত থাকা স্থানীয় সাংবাদিকদেরও সরবরাহ করেননি তিনি৷ মূলত স্কুলে কোনোপ্রকার জবাবদিহিতা না থাকায় রেজাউলের মতো বিতর্কিত ও জমি ব্যবসায়ী স্কুলটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছেন বলে অভিমত সূধীজনের। 


কিছুদিন পূর্বে তিনি স্কুলের সাবেক এক ছাত্রকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন৷ এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে রেজাউল ওই ছাত্রের বাসায় গিয়ে নিঃশর্তভাবে মাফ চান৷ আজকের সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ বিষয়ে প্রথম জানান, তিনি কারো গায়ে হাত তোলেননি৷ এর এক মিনিটের মাথায় তিনি স্বীকার করেন যে ওই ছাত্রকে তিনি নিজে উত্তম মাধ্যম দিয়েছেন৷

 

তার এমন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড চরিত্র দেখে সংবাদ সম্মেলনে হাসির রোল পড়ে৷ নিয়মানুযায়ী এডহক কমিটির সদস্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বিদ্যালয়ের সভাপতির অনুমোদন প্রয়োজন হয়, তবে রেজাউল সেই নিয়মের থোড়াই কেয়ার করেছেন। বিদ্যালয়ের কয়েকটি সুউচ্চ ভবন দেখিয়ে একে নিজেদের সফলতা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা চালালেও মূলত ভবনগুলো এমপি শামীম ওসমানের প্রচেষ্টায় সরকারি অনুদানে নির্মিত হয়েছে।

 
অনিয়ম-দুর্নীতির অর্থের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ২০১৮ সালে তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির আরেক সদস্য জুয়েল খানের সাথে লজ্জাজনকভাবে স্কুলের ভেতরেই প্রকাশ্যে মারামারি করেছেন রেজাউল৷ জুয়েল খানের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে বিমর্ষ হয়ে অফিস রুমে পড়ে থাকা রেজাউলের ছবি ওই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়, যা হাস্যরসের উদ্রেক ঘটায় সর্বত্র। 


একাধিক অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা যায়, রেজাউলের নির্দেশেই ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে টাকা নেওয়া হয়৷ কেউ দিতে অস্বীকৃতি জানালে তার সাথে বাজে ব্যবহার করা হয়, অনেকসময় মারধরও করা হয়৷ শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের বেতন- ফিসের টাকায় শিক্ষার্থীদের ও অভিভাবকদের ছাড়াই রেজাউলের উদ্যোগে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও তাদের পরিবারের লোকেদের নিয়ে পিকনিক করা হয়, যা নিয়ে জেলাজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

 

এমনকি যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষকের পক্ষেও দৌড়ঝাপ করতে দেখা গেছে রেজাউলকে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষার্থীদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটলেও রেজাউল করিমের হুমকিতে ছাত্রীরা মুখ খোলার সাহস পায় না৷ তবে সম্প্রতি দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থীকে এক শিক্ষকের কুপ্রস্তাবের ঘটনা ফাঁসের পরে অনেক ছাত্রীই মুখ খোলেন৷ 


অনুসন্ধানে জানা যায়, একসময়ের বেকার যুবক রেজাউল করিম চিতাশালে ছোট্ট এক রুমে ভাড়ায় বসবাস করতেন৷ ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে রেজাউল বিভিন্ন ব্যক্তির দলিল সংক্রান্ত সমস্যা দেখা শুরু করেন৷ 


অভিযোগ রয়েছে, অনেক দলিল জাল-জালিয়াত, প্রতারণার মাধ্যমে একসময়ের ভবঘুরে, ছাপোষা, বেকার যুবক রেজাউল অর্থ-সম্পদের মালিক হন৷ আর অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ধরে রাখতেই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী মহলের চাটুকারিতায় ব্যস্ত থাকেন ধুরন্ধর রেজাউল। 


তবে স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, স্বল্প শিক্ষিত রেজাউল করিম নিজের আখের গোছাতে গিয়ে পাগলা স্কুলের ভাবমূর্তিকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন ইতোমধ্যে৷ এমপি শামীম ওসমান স্কুলের জন্য ব্যাপক বরাদ্দ আনলেও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের কারণে সংসদ সদস্যের সফলতা ম্লান হচ্ছে৷ 


অন্যদিকে রেজাউল করিম শামীম ওসমানের নাম ব্যবহার করে দিব্যি অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন, অথচ এসব বিষয়ে সংসদ সদস্য কিছুই জানেন না৷ তাই অচিরেই বিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধকল্পে সংশ্লিষ্ট মহলের কঠোরতম হস্তক্ষেপ দাবী করেছেন অভিভাবক মহল।
 

সম্পর্কিত বিষয়: