নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শুক্রবার,

১৯ এপ্রিল ২০২৪

রূপগঞ্জের ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করল র‌্যাব,গ্রেফতার ৭

নারায়ণগঞ্জ টাইমস

প্রকাশিত:০০:২৫, ১৮ আগস্ট ২০২১

রূপগঞ্জের ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করল র‌্যাব,গ্রেফতার ৭

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস জাহিদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক রহস্য উদঘাটন এবং মূল হত্যাকারীসহ ৭ আসামিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-১১। 


গ্রেফতারকৃতরা হলো- হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রধান আসামি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার আদর্শ গ্রামের মো. গফুর আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩০), পঞ্চগড় জেলার মসজিদপাড়ায় শামীম (৪০), গাইবান্ধার দূর্গাপুরের ইব্রাহীম খলিলের ছেলে রনি মিয়া ওরফে টনি (৩০), রংপুরের পীরগাছার ইব্রাহীম শেখের ছেলে আব্দুল মান্নান শেখ (২২), নাটোরের সিংড়ার পুটিমারীর লস্কর প্রমাণিকের ছেলে সুমন (৩৮), বাগাতিপাড়ার গালিমপুরের মৃত তাইজ উদ্দিনের ছেলে মামুনুর রশিদ (৩৫) ও গাজীপুরের জয়দেবপুরের চান্না বৌবাজার এলাকার হাবিবুল্লাহ (৫২)। 


মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা। এরআগে র‌্যাবের অভিযানে ১৬ আগস্ট (সোববার) রাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। 


সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা আরো জানান, গত ২১ জুলাই নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন টেংরারটেক সাকিনস্থ এশিয়ান হাইওয়ে রোডের পশ্চিম পাশের মাল্টি-ব্র্যান্ড গ্রুপের বাউন্ডারি সংলগ্ন ডোবার মধ্যে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির মরদেহ পাওয়া যায়।  


২৪ তারিখ হাসপাতাল মর্গে উপস্থিত হয়ে মো. কাজল হোসেন (২১) নামে এক ব্যক্তি মরদেহের ছবি ও পরনে থাকা কাপড় দেখে সেটি তার বাবা জাহিদুল ইসলামের বলে শনাক্ত করেন। এরপরেই অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের নামে নিহতের ছেলে মো. কাজল হোসেন বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।


এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহসহ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও ঘটনায় জড়িত অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের গ্রেফতারে র‌্যাব-১১ এর একটি গোয়েন্দা দল ছায়া তদন্ত শুরু করে।  র‌্যাব তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্লুলেস এ হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়।

 

র‌্যাবের অভিযানে ১৬ আগস্ট (সোববার) রাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে এ ঘটনায় জড়িত    ওই সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। 


প্রাথমিক অনুসন্ধান ও গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ১৮ জুলাই রাতে ওই অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা সাইফুল ইসলাম ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে এবং তার সহযোগী রনি মিয়া গাইবান্ধা থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় অবস্থানরত শামীম, আব্দুল মান্নান শেখ, সুমন, মামুনুর রশিদ ও হাবিবুল্লাহসহ ৯ জনের একটি দল সাইফুলের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়। 


ওই চক্রের মূলহোতা সাইফুলের একজন অন্যতম সহযোগীসহ আরো ৫ জনের একটি দল নাটোর থেকে ১টি ট্রাক নিয়ে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা এসে সাইফুলের দলের সঙ্গে মিলিত হয়। ১৯ জুলাই ভোরে নারায়ণগঞ্জ হয়ে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় তারা।


জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, তারা ঘটনার দিন দুপুরে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় আসে। তবে, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। সন্ধ্যার পর অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা সাইফুল নিজে যাত্রী সেজে ঈদে ঘরমুখো সাধারণ যাত্রীদেরকে কম টাকায় পরিবহনের আশ্বাস দিয়ে জাহিদুল ইসলামসহ তার সঙ্গীয় আলম (৫০), আরিফ (৩০), শরীফুল ইসলাম (৫০) ও সবুজসহ (৩০)  মোট ৫ জন যাত্রীকে সু-কৌশলে তাদের ট্রাকে উঠিয়ে নাটোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।


এরপর ওই যাত্রীদের নিয়ে কিছুদূর আসার পরে তাদের ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত শুকনো খাবার ও কোমল পানীয় সু-কৌশলে জাহিদুল ইসলামসহ ৪ জন যাত্রীকে খাওয়ায়। এতে কিছু সময় পর অজ্ঞান হলে তাদের কাছে থাকা সবকিছু লুট করে নেয় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। তবে এদের মধ্যে একজন যাত্রী খাবার না খাওয়ায় তাকে বেধড়ক মারধর করেন। 


পরে কুমিল্লার দাউদকান্দি ব্রিজ পার হলে অজ্ঞানরত ৩ জন যাত্রীকে রাস্তার পাশে ফেলে দেয় অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা। তারপর কিছুদূর আসার পর অজ্ঞান না হওয়া যাত্রীকে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। 


সবশেষে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন এশিয়ান হাইওয়ে রোডের পশ্চিম পাশের ঝোপঝাড়ের মধ্যে জাহিদুল ইসলামকে ফেলে দেয়। তবে, জাহিদুল ইসলামের কাছে টাকা পয়সা কম থাকায় সাইফুলের নেতৃত্বে আসামিরা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে কিল-ঘুষি ও প্রচণ্ড মারধর করে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। ধারণা করা হয়, ওষুধের বিষাক্ত প্রভাব এবং প্রচণ্ড মারধর করায় জাহিদুল ইসলামের মৃত্যু হয়।


এদিকে প্রাথমিক অনুসন্ধান ও গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অজ্ঞান পার্টি চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে (প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর) ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় একইভাবে যাত্রীদের অজ্ঞান করে টাকা, মূল্যবান সামগ্রীসহ যাত্রীদের সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে আসছিল।  


ক্রাইম ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বিশ্লেষণ করে জানা যায়, গ্রেফতারকৃত ওই চক্রের মূলহোতা মো. সাইফুল ইসলামসহ তার সহযোগী অন্যান্য আসামিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটনের দায়ে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।  


অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চক্রটির মূলহোতা মো. সাইফুল ইসলামের নামে চেতনানাশক ওষুধ খাওয়ায় চুরি করার অপরাধে গত ২০১৬ সালে ২৯ নভেম্বর তারিখে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় ১টি, ২০১৯ সালে একই থানায় জুয়া আইনে ১টি এবং ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল তারিখে বগুড়া সদর থানায় চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে চুরি করার অপরাধে ১টিসহ মোট ৩টি মামলা রয়েছে। 


২০১৬ সালে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় রুজু করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে ৩ মাস ও ২০১৯ সালে একই থানায় রুজু-কৃত মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১৫ দিন কারা ভোগ করে। 


আসামি রনি মিয়া টনির বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানায় নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে অটোভ্যান চুরি করার চেষ্টার অপরাধে ও ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করার অপরাধে ২টি মামলা রয়েছে। ওই ২টি মামলায় গ্রেফতার হয়ে সে সর্বমোট ৩ বছর কারাভোগ করে।


এছাড়া আসামি আব্দুল মান্নান শেখের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানায় চুরি করার অপরাধে ১টি মামলা রয়েছে। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রেফতার হয়ে সে ৫ দিন কারাভোগ করে। 


আসামি মামুনুর রশিদর বিরুদ্ধে ২০০৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার জিআরপি থানায় ১টি, ২০০৮ সালে ৭ সেপ্টেম্বর নাটোরের লালপুর ও বড়াইগ্রাম থানায় নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে চুরি করার অপরাধে ২টি ও ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি নাটোর সদর থানায় একই অপরাধের কারণে ১টিসহ মোট ৪টি মামলা রয়েছে।


ওই আসামি ২০০৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার জিআরপি থানার মামলায় সাড়ে ১১ মাস, ২০০৮ সালের পৃথক ২টি মামলায় আড়াই বছর এবং ২০২১ সালের অপর ১টি মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১৪ দিন কারাভোগ করে।  
গ্রেফতারকৃত আসামি মামুনুর রশিদ দীর্ঘ ২০ বছর অজ্ঞানপার্টি চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করে আসছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে।


একই দিনে ওই চক্রটি গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় ৩ জন ব্যক্তিকে ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত কোমল পানীয় মিরিন্ডা পান করিয়ে অজ্ঞান করে ১৩ হাজার টাকা এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এক গরু ব্যবসায়ীকে একই কায়দায় অজ্ঞান করে ১ লাখ ৩৪ হাজার লুট করে নেয় বলে স্বীকার করে।


গ্রেফতারকৃত আসামিদের সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন বলে জানায় র‌্যাব।