নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শনিবার,

২০ এপ্রিল ২০২৪

রূপগঞ্জের ভূলতা ফ্লাইওভারের নিচে

একই বিছানায় পথ শিশু ও কুকুরের ‘সুখনিদ্রা’ 

নারায়ণগঞ্জ টাইমস:

প্রকাশিত:০২:১০, ১৭ মার্চ ২০২২

একই বিছানায় পথ শিশু ও কুকুরের ‘সুখনিদ্রা’ 

রাত শেষে দিনের আলো উঁকি দিয়েছে। দুই পথ শিশু তখনো ঘুমিয়ে আছে। তবে বিছানা ছেড়ে তাদের একজন উঠে পড়েছে। প্লাস্টিকের কাগজ আর ছেঁড়া কাথায় কম্বল গায়ে মুড়িয়ে থাকা দুই শিশুর মাথা বেরিয়ে আছে। তাদের বিছানায় একটি ঝাড় –আর পায়ের নিচে জবুথবু হয়ে ঘুমাচ্ছে একটি কুকুর। শিশুদের সঙ্গে কুকুরটির সুখনিদ্রা যাওয়ার দৃশ্য পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল।


নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভূলতা ফ্লাইওভারের নিচে ঘুমিয়ে থাকা এই শিশুদের মুখে জানা গেল তাদের কস্টের গল্প।


তাদের তথ্যমতে, বগুড়া জেলার সোনা তালা উপজেলার কাচারি বাজারের বাবর আলীর তিন সন্তান লিখন (৭) নাহিদ (৯), লাবু (১২)। তাদের বাবা বাবুর আলীর মৃত্যুর পর তাদের মার সাথে রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল আসে। অভাব অনাটনের কারণে তাদের মা গোলাকান্দাইল চৌরাস্তা এলাকায় রেখে চলে যায়। তার পর থেকে তারা জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য রাস্তায় রাস্তায় টোকাইয়ের মতো জীবন কাটাচ্ছে। তারা প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে গাউছিয়া মাছের আড়তে মাছ টোকায়। পরে তা বিক্রি করে। তা দিয়ে কোনো মতো চলছে তাদের তিন ভাইয়ের জীবন সংগ্রাম। আর রাত হলে ভূলতা ফ্লাইওভারের নিচেই প্লাস্টিকের কাগজ, পাটের চট, ছিড়ে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। 


তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে পথশিশু নাহিদ জানায়, আমরা পথশিশু আমাদের বসবাস রাস্তার কুকুরের সাথেই। আমাদের লেখা পড়া কে করাবে? ঠিক মতো খেতেই পাইনা আবার লেখা পড়া! কতো মানুষের লাথি-উস্টা খেয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। 


ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা আকমল হোসেন নামে এক চাকরীজীবি বলেন, এ সমাজে কত পরিবার আছে যাদের নিজেদের বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট না থাকার জন্য আফসোস করে। আবার কারো একাধিক বাড়ি, গাড়ি ও অর্থ-সম্পদ রয়েছে। কিন্তু অনেকেই সুখে ঘুমাতে পারেন না। সেদিক থেকে ভাসমান এই শিশুগুলো হয়তো অনেক সৌভাগ্যবান। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই, শীতের ভালো জামা-কাপড়, জুতা নেই কিন্তু ওরা শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমায় ওরা। এক অর্থে ধনী ব্যক্তিদের চেয়ে ওরাই সুখে আছে- এ কথা বলে নিজের কর্মস্থলের দিকে রওয়ানা হন আকমল হোসেন।


এদিকে লিখন, নাহিদ ও লাবু মতো আরও কয়েক পথশিশুর সঙ্গে দেখা মিললো এই প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে চাঁদপুর জেলার মধ্য মদনা এলাকার আব্দুল হালিমের ছেলে সোহাগ (১০) জানায়, তার মা জীবিত ছিলো যখন তখন সে ২য় শ্রেণী পর্যন্ত লেখা-পড়া করেছে। তারপর আর কখনো স্কুলে যেতে পারে নাই। মা মারা যাওয়ার পর থেকে সে বাবার কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছিলো তাই তাকে নানীর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। নানীর বাড়িতেও ঠিক মতো খেতে পারে নাই। বিছানায়  প্র¯্রাব করে দেয় বলে তাদের কাছেও ঠিক মতো থাকতে পারে নাই সোহাগ। সোহাগ এখন ভূলতা ফ্লাইওভারের নিচে থাকে। 


১১ বছর বয়সী এমদাদ হোসেন জানায়, তার মা নেই বাবা অসুস্থ। তার আর এক ভাই এক বোন রয়েছে। বোন মরিয়ম (৭), ছোট ভাই আলিফ (৫)। গত ৫ বছর আগে তার মা মারা যায়। বাবা আসাবুল (৪৭) আগে ভ্যানগাড়ি চালাতেন। গত দুই বছর আগে পায়ে আঘাত লাগে তার পর থেকে তার বাবার পা পঁচে যায়। তাই তার বাবা কোনো কাজ করতে পারে না। টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারেন না। তারা মানুষের বাড়ি থেকে ভাত চেয়ে এনে খায়। আর রাত হলে গোলাকান্দাইল হাটে শুয়ে থাকে। বর্তমানে তাদের থাকার মতো কোনো জায়গা নেই। এমদাদ প্রতিদিন ভোরে মাছের আড়তে মাছ টোকায়। তা বিক্রি করে নিজেরই হয় না। আবার ভাই-বোন বাবার চিকিৎসা। অনেক কষ্টে কাটছে তাদের দিন। 


 

সম্পর্কিত বিষয়: