নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

বৃহস্পতিবার,

২৫ এপ্রিল ২০২৪

রূপগঞ্জের তাঁত শিল্পীরা এখন চাদর তৈরির শ্রমিক

প্রকাশিত:২১:১৪, ১ এপ্রিল ২০২১

রূপগঞ্জের তাঁত শিল্পীরা এখন চাদর তৈরির শ্রমিক

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন, মাহনা, ভূলতা, গোলাকান্দাইল গ্রামের মানুষের এক সময় ঘুম ভাংতো তাঁতের খটখট শব্দে। ব্রিটিশ আমলেই রূপগঞ্জের এসব এলাকায় গড়ে উঠেছিল তাঁত কারখানা। এখানকার তাঁতের গামছা, লুঙ্গি ও মোটা শাড়ির বেশ কদর ছিল। এসবের সাথে যুক্ত হয়েছিল তাঁতের সুতি মশারি। এই সুতি মশারি একদিন সমগ্র বাংলাদেশে সমাদৃত ছিল। কিন্তু কালের চক্রে সেই তাঁত শিল্প ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ব্রিটিশ সরকার কলের কাপড় বাজারজাত করতে এক সময় তাঁতিদের হাতের আঙুল পর্যন্ত কেটে দিয়েছিল। তখন ঢাকার তাঁতিরা নিজ এলাকা থেকে পালিয়ে নৌপথে রূপগঞ্জের এসব এলাকায় আত্মগোপন করেন। অধিকাংশ তাঁতিই আশ্রয় নিয়েছিলেন রূপগঞ্জের কাঞ্চন, ভূলতা, সাওঘাট এলাকায়। আত্মগোপনে থাকা এসব তাঁতিরাই এক সময় এখানে গড়ে তোলেন তাঁত কারখানা। সেই থেকে রূপগঞ্জের এসব এলাকা তাঁতি এলাকা হিসেবে পরিচিতি পায়।

তাঁত বোর্ডের জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৫ বছর আগেও রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছোট বড় তাঁতের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারেরও বেশি। সুতা, ডাইস, কেমিক্যালের সংকট ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং পুঁজি সংকটে ক্রমান্বয়ে তাঁত কারখানা গুটিয়ে নেন ছোট তাঁতিরা।

কাঞ্চন এলাকার সুতি মশারির কপড় তৈরির সাথে জড়িত তাঁতিরা জানান, চোরাপথে আমদানি করা কলের তৈরি কাপড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তাঁতিরা টিকতে পারছিল না। চোরাপথে আসা নিম্নমানের সস্তা কাপড় অবাধে বাজারজাত হওয়ায় তাঁতিরা মার খাচ্ছিল। সেই থেকে ক্রমান্বয়ে এখানকার তাঁতিরা বংশগত ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় নেমেছে।

রূপগঞ্জের তাঁত শিল্পীরা এখন চাদর তৈরির শ্রমিক

ভূলতা এলাকার তাঁতিরা জানান, তাঁতির সংখ্যা কমতে কমতে বর্তমানে অর্ধেকে নেমে এসেছে। রূপগঞ্জের গামছা শিল্পের অনেক আগেই বিলুপ্তি ঘটেছে।

ষাটের দশকের পর রূপগঞ্জ এলাকার তাঁত বস্ত্রকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে সমবায় অধিদফতরের অধীনে শিল্প সমবায় সমিতি গঠনসহ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল প্রশিক্ষণ, ঋণ প্রদান ও তৈরি কাপড় বাজারজাতকরণ। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ সমিতির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আর এ সময়ের মধ্যে ঘটে গেছে মারাত্বক বিপর্যয়। এ দেশে ব্যাপক হারে পাওয়ার লুম শিল্প গড়ে ওঠার পর এ শিল্প রীতিমতো থমকে দাঁড়ায়।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রূপগঞ্জে দুই সহস্রাধিক তাঁতি পরিবার ছিল। বর্তমানে এখানে সব মিলিয়ে পঞ্চাশের বেশি তাঁত চালু নেই। আগে যেখানে লুঙ্গি, শাড়ি, গামছা তৈরি হত, সেখানে এখন তাঁতিরা শুধুমাত্র মশারির কাপড় তৈরি করে কোনোমতে পৈত্রিক পেশা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই বাড়ির উঠানে অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে তাঁত। বাকিদের তাঁত মণ দরে বিক্রি হয়ে গেছে বাজারে।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুসরাত জাহান জানান, রূপগঞ্জের গামছা, সুতি মশারি বিলুপ্ত হলেও কাঞ্চনের শীতের চাদর শিল্পের বেশ প্রসার ঘটেছে। কাঞ্চনের শীতের চাদর (শাল) এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। যাচ্ছে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, নেপাল, ভূটানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

অনেকেই পেশা বদলে ইঞ্জিনচালিত মেশিনে শীতের চাদর তৈরির সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। আগে যেসব তাঁত শিল্পীদের নিজেদের তাঁত ছিল এখন তারা চাদর তৈরির কারখানার শ্রমিক। তবে এখানকার তৈরি চাদরের কদর থাকলেও গামছা ও সুতি মশারি শিল্প বিলুপ্তপ্রায়।