নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শুক্রবার,

২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রতিহিংসা কোভিড-১৯ থেকেও ভয়াবহ : তৈমূর আলম

তৈমূর আলম খন্দকার

প্রকাশিত:২৩:০০, ৪ জুন ২০২২

প্রতিহিংসা কোভিড-১৯ থেকেও ভয়াবহ : তৈমূর আলম

প্রতিবৎসর জুনমাস আসলেই মনটি আত্কে উঠে। কারণ জীবনে যত অপবাদের সম্মূখীন হয়েছি, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশী কলঙ্কজনক অধ্যায়ের শিরোনাম হয়েছিলাম ২০০১ সালের জুন মাসে। ঐ সময়ে পরবর্তী পূরো কয়েকটি বৎসর আমি সহ আমার সহকর্মীদের অতিক্রম করতে হয়েছে মহা আতঙ্কে একটি বিষাদময় কলঙ্ক মাথায় নিয়ে। কারণ আমিসহ আমার সাথে সম্পৃক্ত এজাহারভুক্ত আসামীদের গভীর আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছিল। যখনই ঐ দু:সময়ের কথাগুলি মনে হয় তখনই জীবনের হিসাব মিলাতে গিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, নোংরা এই সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই কি রাজনীতিতে সক্রিয় হলাম?

 

১৯৭৪ ইং সনের ১৬ই জুন তৎকালিন বাকশাল সরকার ৪টি জাতীয় পত্রিকা চালু রেখে বাকী সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ায় সাংবাদিক সমাজ প্রতিবৎসর ১৬ই জুন দিবসটিকে কালো দিবস হিসাবে উৎযাপন করে আসছে। কিন্তু আমার জন্মভ‚মি নারায়নগঞ্জের কালো রাত্রি হলো ২০০১ ইং সনের ১৬ই জুন। প্রতিহিংসার রাজনীতি কত প্রকার ও কি কি হতে পারে তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেহ উপলব্দি করতে পারে না। প্রতিহিংসাকে কার্যকর করার জন্য পূর্ব জামানার বিভিন্ন কৌশলের সাথে সম্প্রতি সম্পৃক্ত হয়েছে “আইন” ও “আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।” কারণ আইনকে অপপ্রয়োগ করে বা ইচ্ছা মত আইন প্রনয়ণ করে রাষ্ট্রীয় সার্ভেন্টদের মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজেই নাগরিকদের নিপীড়ন করে, মনোবাসনা পূর্ণ করে তাদের যাদের হাতে থাকে রাষ্ট্রীয় দন্ডমূলের দাদাগীরি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বহু অপপ্রয়োগের মাধ্যমেই পৃথিবীব্যাপী অনেক অনেক ঘটনা রয়েছে যা কিছু অংশ প্রকাশিত, বাকী অধিকাংশই রয়েছে অপ্রকাশিত, কোথাও প্রভাবশালীদের চাপে, কোথাও ভিন্ন ভিন্ন কারণে, তবে অধিকাংশই ক্ষেত্রেই নিপীড়িতদের দূর্বলতা ও মিডিয়ার পক্ষ পাতিত্বমূলক আচরণের কারণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অনেক ঘটনাই হয় চাপা পড়ে থাকে, নতুবা প্রচারিত হয় ভিন্নভাবে।

 

ইতিহাসের কোথাও ভিলেন হয়ে পড়ে নায়ক, নায়ক হয়ে পড়ে ভিলেন এবং পৃথিবীর অনেক ঘটনাই আছে যা নায়ক বা ভিলেন কেহ দায়ী নয়, বরং সংগঠিত হয়ে থাকে তৃতীয় পক্ষ দ্বারা। কথা প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, ২০০১ সালে ১৬ জুন নারায়নগঞ্জ শহরে চাষাঢ়ায় তৎকালিন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অফিসে পৈচাশিক বোমা হামলায় ২২ জন নিরীহ সাক্ষাৎকার প্রার্থী (পুরুষ/মহিলা) মানুষ নিহত হয়, যাদের মধ্যে নজরুল ইসলাম বাচ্চু নামে সম্ভবনাময় কন্ঠ শিল্পী নিহত হয়ে ছিল, শামীম ওসমান (তৎকালিন ও বর্তমান এম.পি) সহ অনেকেই আহত হয়েছেন, চন্দনশীল নামে এক সম্ভবনাময় উদিয়মান রাজনৈতিক যুব ব্যক্তিত্ব চিরতরে একটি পা হারিয়েছেন এবং আরো অনেকেই পঙ্গু হয়েছে যার সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।

 

এমন পৈচাশিক ঘটনার নিন্দা জানানোর কোন সূযোগ পাই নাই, কারো দু:ক্ষের সাথে নিজের অশ্রু ঝড়াতে পারি নাই। কারণ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবি সমিতির ২০৫নং কক্ষে আমার পেশাগত কিউবিক্যালে বসে যখন ঘটনা শুনে আহত নিহতদের পাশে থাকার জন্য নারায়নগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই জানতে পারি আমার নেতৃত্বে পৈশাচিক বোমা হামলার অভিযোগে আমার বাড়ীতে হামলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্দ লোকজন আমার বাংলো বাড়ীর টিনের চাল গুলি করে ঝাঝরা করে দিয়েছে, বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ায় আমার বৃদ্ধ পিতা মাতা এক কাপড়ে বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে, পরে আরো জানতে পারি যে, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে “তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বে এই পৈচাশিক হামলা।”

 

সংবাদে আরো প্রচার হয় যে, “ঘটনার মূল নায়ক তৈমূর আলম খন্দকার এখনো ধরা পড়েনি।” এ সংবাদ শুনে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (রূপগঞ্জ) সাবেক ইউপি সদস্য মফিজ মেম্বারের পুত্র ছাত্রদল নেতা শফিক সুপ্রীম কোর্ট থেকে হোন্ডা করে আমাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গোপন স্থানে রেখে আসে। পরে জানতে পারি আমাকে প্রধান আসামী করে বিএনপি’র আরও ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে নারায়নগঞ্জ থানায় ৯(৬)২০০১ ধারা ৩০২ দ: বি: এবং নারায়নগঞ্জ থানায় ১০(৬)২০০১ ধারা ৩/৪ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুইটি পৃথক মামলা করা হয়। মামলা হওয়ার পর নিজের উপর দ্বিক্কার জন্মে এ জন্য যে, ঘটনার সাথে যাদের সম্পৃক্ততা নাই তাদের’কে ২২ জন লোক হত্যায় জড়িয়ে মামলা দেয়ার নামই কি রাজনীতি? মিডিয়ার সংবাদশুনে আমার জেষ্ঠ্যেকন্যা ভিকারুননেছা স্কুলের তৎকালীন ছাত্রী (ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম) আত্মগোপন অবস্থায় টেলিফোনে আমাকে বলে ছিলো যে, “রাজনীতির কারণে তোমরা বোমা মেরে কি মানুষ খুন করতে পারো?”

 

এ ধরনের অপবাদের মানসিক যন্ত্রনা মাথায় নিয়ে আমাকে কাটাতে হয়েছে ১৩টি বৎসর। আমাদের বিরুদ্ধে ঘটনার সম্পৃক্ততা না পেয়ে উক্ত মামলাগুলিতে পুলিশ ফাইনাল রির্পোট দেয়, সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতি জুডিশিয়াল ইনকুয়ারী করে আমাদের নির্দোষ মন্তব্য করে ঘটনাটি তৃতীয় পক্ষ দ্বারা সংগঠিত হয়েছে বলে মন্তব্য করে প্রতিবেদন দেন। ২০০৮ ইং সালের ডিসেম্বর মাসে বাদী পক্ষের আবেদনে হাই কোর্টের নির্দেশে মামলাটি আবার পুন: চালু হয়। দীর্ঘ ১৩ বৎসর মামলাটি অমানুষিক যন্ত্রনা মাথায় নিয়ে চলাবস্থায় ০২/০৫/২০১৩ ইং তারিখে জানতে পারি যে, উক্ত পৈচাশিক ঘটনার সাথে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা না থাকায় সি.আই.ডি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে মোকদ্দমা থেকে আমাদের অব্যাহতি দেয়ার প্রার্থনা করা হয়েছে।

 

এ ঘটনায় যারা মৃত্যু বরণ বা আহত হয়েছে তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন ক্ষতি পূরণ পেয়েছে কি না জানি না, তবে এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার মত নয়। তবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতি পূরণ দেয়া উচিৎ ছিল। কারণ যারা নিহত বা আহত হয়েছে তারা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ মামলার অন্যতম আসামী জাহাঙ্গীর কমিশনার, রফিক কমিশনার দুনিয়া থেকে চলে গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন গুরুতর অসুস্থ্য। পৃথিবী থেকে আমরা চলে যাবো, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের রেখে যাচ্ছি কোন অবস্থায়? তবে এ ধরনের ঘটনায় কোন চির-শক্রুর মৃত্যু চাই না এবং মিথ্যা ভাবে কোন চির শক্রুকেও যেন আসামী না করা হয়। পৃথিবী হয়তো একদিন সম্পূর্ণভাবে করোনা মুক্ত হবে, কিন্তু প্রতিহিংসা বা বর্ণ ও ধর্মীয় বৈষম্যোর ভাইরাস থেকে মুক্ত হবে কি না জানি না, তবে দৃশ্যপট বলে প্রতিহিংসার ভাইরাস করোনা ভাইরাস থেকে আরো জঘন্য ও নির্মম। মানুষ হত্যা করা এবং হত্যা মামলায় জেনে শুনে নির্দোষ ব্যক্তিকে জড়িয়ে আসামী করার পৈচাশিক সংস্কৃতি থেকে পৃথিবী মুক্তি পাক এটা দৃঢ়ভাবে কামনা করি।

 

হাই কোর্ট আমাকে জামিন দেয়ার প্রতিবাদে অর্ধবেলা নারায়নগঞ্জ হরতাল হয়েছিল। ১৯৯৭ ইং সনের ১৮ই সেপ্টেম্বর প্রতিহিংসার কারণে রাজপথে বিএনপি’র মিছিলে যে গুলি খেয়েছি, তা শরীরে এখনো বহন করছি, একই ঘটনায় নিহত হয়েছিল সহকর্মী ইব্রাহিম। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমাকে, আমার পরিবার ও সহকর্মীদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন অকারনে মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করেছে, বাড়ী ঘরে হামলা করেছে, নারায়নগঞ্জের আমার চেম্বার পুড়িয়ে দিয়েছে, পুলিশ দ্বারা রাজপথে বার বার শারিরিকভাবে নির্যাতিত ও নিগৃত হয়েছি। রাষ্ট্রীয় সার্ভেন্ট যারা আমাদের গায়েবী মামলা দিয়েছে, বৈষম্য মূলক আচরণ করেছে, মিথ্যা মামলায় জেল খাটাইয়াছে তাদের সকলকেই আল্লাহ মাফ করে দিন, আমি যদি কারো প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরন করে থাকি, তার নিকট আমিও জোর হাতে মাফ চাই।

 

গত বৎসর নারায়ণগঞ্জ শেসন কোর্টে এই মামলায় স্বাক্ষী দিতে এসে ঘটনার অন্যতম জখমী শামীম ওসমান এম.পি বলেছেন যে, “এই বোমা হামলায় তৈমূর বা তার সহযোগীরা জড়িত নহে।” এ সরল স্বীকারোক্তি যদিও আমার ১৩ বৎসরের মানসিক যন্ত্রণা ও মিথ্যা অপবাদের ক্লান্তি থেকে আমাকে সস্থি দিয়েছে, তথাপি বলতে চাই যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষতার কারণে কাহারো উপর যেন এ ধরনের অপবাদ বা অভিযোগ চাপিয়ে একটি পরিবারের উপর বিষাদের প্রকোপে প্রশ্নবিদ্ধ না করা হয় এবং এটাই হউক সভ্যতার দাবী।

 

তবে একটা কথা বলতে চাই যে, ঘটনা ঘটায় একজন বা একদল অথচ প্রতিহিংসার কারণে মামলায় জড়ানো হয় অন্যজনকে, বা কোন দল বা গোষ্টিকে, এ সংস্কৃতি থেকে মানবজাতি বা আমাদের সমাজ কি সরে আসবে না? মিথ্যা আসামী দেয়ার কারণে মূল আসামী রক্ষা পেয়ে যায়। দিল্লীর রেল ষ্টেশন বোমামেরে উড়িয়ে দেয়ার সময় সহোদর আনিসুল মোরসালিন ও মহিবুল মুত্তাকিন যদি নারায়নগঞ্জে ১৬ই জুনের (২০০১ ইং) বোমা বিস্ফোরনের ঘটনার কথা স্বীকার না করতো তবে হয়তো এতো দিনে দেশের আইন ও আদালত আমাদের গলায় দড়ি লাগিয়ে দিতো। পরম করুনাময় আল্লাহপাক বলেছেন যে, “তোমাদের ইচ্ছা কোন বিষয় গোপন রাখা এবং আমার অভিপ্রায় তা প্রকাশ করা।” পরমকরুনাময় আল্লাহ সত্যকে প্রকাশ করে আমাদের উপর মেহেরবানী করেছেন, তাই আল্লাহপাকের দরবারে লক্ষো কোটি শুকরিয়া।

 

আমরা যারা নিজেদের সমাজ সচেতন হিসাবে দাবী করি এবং জোর গলায় মাইক ফাটিয়ে বক্তৃতার মঞ্চে বলি যে, “আমরা দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য রাজনীতি করি।” আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে কি আমরা প্রশ্ন করি যে, মঞ্চের বক্তৃতা ও আমাদের ব্যক্তি জীবনের সমন্বয় কতটুকু? মানুষসহ পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। চিরন্তন সত্য যে, মানুষকে নাম, যশ, ক্ষমতা, অর্থ-সম্পদ, প্রতিপত্তি রেখে সম্পূর্ণ খালি হাতে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়। আমরা রেখে যাবো আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে। আমাদের কর্মকান্ড, পৈশাচিকতা এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মানসিকতার কারণে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এ পৃথিবী কতটুকু নিরাপদ হবে? প্রতিটি কর্মের জন্য মানুষকে জবাবদিহি হতে হয়। নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আমরা সমাজকে যে অসস্থিকর অবস্থায় রেখে যাচ্ছি ভবিষ্যত প্রজন্মের নিকট আমাদের জবাবদিহিতার জবাব কি থাকবে?   

 

সম্পর্কিত বিষয়: