
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নারায়ণগঞ্জ বন্দরে আধিপত্য বিস্তারে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য ও নাসিক ২১নং ওয়ার্ডের সাবেক দুই বারের কাউন্সিলর হান্নান সরকার ও তার বাহিনী। ৫ আগষ্টের পর পরই তিনি ঐক্যবদ্ধ করেন তার উশৃঙ্খল কর্মী বাহিনী।
এর মধ্যে রয়েছেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক ত্রান বিষয়ক সম্পাদক বাবু সিকদার,বন্দর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ন আহ্বায়ক মেহেদী হাসান,বিএনপি কর্মী মাসুদ রানা রনি। সাথে যুক্ত হয় অটোচালক জাফর ও জুয়ারী বাবু,মাদক ব্যবসায়ী রায়হান,কিশোর সন্ত্রাসী পারভেজ,মুরগী নয়নসহ একাধিক সন্ত্রাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর হান্নান সরকার মুলত নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপি সমর্থিত এমপি এ্যাডভোকেট আবুল কালাম ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউছার আশা সমর্থিত রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য ও ২১ নং ওয়ার্ডের সাবেক দুই বারের কাউন্সিলর হান্নান সরকার আ'লীগ সরকার শাষনামলে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমানের সভামঞ্চে সক্রীয়, নিবির সসখ্যতা ও চাটুকারিতার কারনে বিএনপি কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।
পরে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হান্নান সরকার তার উশৃঙখল বাহিনী নিয়ে অপ্রতিরোধ্য ও প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠেন। বন্দর ২১নং ওয়ার্ডে আ'লীগের নেতা কর্মীরা বৈষম্য বিরোধী মামলায় জড়িয়ে আত্বগোপনে থাকার পর হান্নান সরকার শাহীমসজিদ পঞ্চায়েত কমিটি,বাজার কমিটি,বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জোরপূর্বক আধিপত্ত বিস্তার করেন।
হান্নান সরকারের শেল্টারে বেপরোয়া হয়ে উঠেন তার বাহিনী বাবু-মেহেদী ও রনি- জাফর গ্রুপ। বন্দর বাসষ্ট্যান্ড দখল করেন হান্নান সরকার সমর্থিত রনি- জাফর গ্রুপ। প্রতিদিন স্ট্যান্ড থেকে চাদা তুলতো ১০০০ টাকা।
অপর দিকে বাবু ও মেহেদী গ্রুপ বন্দর রেললাইন ব্রীজ,বউ বাজার,খালপাড় মাদকের ৩টি ষ্পট গড়ে তুলতো। প্রতিদিন ৩ টি ষ্পট থেকে চাদা তুলত ১২ হাজার টাকা। পরে ষ্ট্যান্ডের দখল ও বিভিন্ন সেক্টরের চাদাবাজীর ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মেহেদী-বাবু গ্রুপের সাথে রনি জাফর গ্রুপের দ্বন্দ হয়।
পরে হান্নান সরকার মেহেদী বাবু গ্রুপের সাথে সমন্বয় করতে রনি জাফরকে নির্দেশ দেন। রনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে হান্নান সরকার ও বাবু মেহেদীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নেতা বদল করেন।
রনির সহায়তায় তার ছোট ভাই জাফর বিএনপি নেতা আবুল কাউছার আশার সহায়তায় বন্দর অটো রিক্সা শ্রমিক সমবায় সমিতির যুগ্ম সম্পাদক হয়ে হাফেজীবাগ এলাকায় একটি অফিস দেন।
রনির ছেলে সন্ত্রাসী রায়হান, পারভেজ, মুরগী নয়নসহ শতাধিক কিশোর সন্ত্রাসী গড়ে তুলেন। এলাকায় আধিপত্ত বিস্তারকে কেন্দ্র করে উভয় গ্রুপের সাথে বিরোধ চরমে পৌছে।
হাফেজীবাগ, বউবাজার, দত্তবাড়ি, রেললাইনসহ বিভিন্ন এলাকাগুলোতে অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উভয় পক্ষের সন্ত্রাসীদের মধ্যে মাঝে মাঝেই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াসহ মারামারির ঘটনা ঘটতো।
এসব কান্ডে নিরব সমর্থন ছিল বিএনপির বহিস্কৃত নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর হান্নান সরকারের। হান্নান সরকারের শেল্টারে বিভিন্ন এলাকায় নতুন বাড়ি করলেই চাদা দিতে হবে মেহেদী বাবু গ্রুপকে।
অবৈধ গ্যাস লাইন,মাদক ব্যবসা,বাড়ি দখলসহ নানা অপকর্ম করতো বাবু মেহেদী গ্রুপ। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে পর ৯ মাস বন্দর শাহীমসজিদ এলাকায় অপ্রতিরোধ্য ছিল হান্নান সরকার সমর্থিত ও আবুল কাউছার আশার এই দুই সন্ত্রাসী বাহিনী।
এলাকার আধিপত্ত বিস্তার’ কে কেন্দ্র করে হান্নান সরকার ও আবুল কাউছার আশার পালিত সন্ত্রাসীদের দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়। বিরোধের জের ধরে বাবু মেহেদী গ্রুপ ও রনি জাফর গ্রুপের কমপক্ষে ৮ জন গুরুতর আহত হয়।
এ ব্যাপারে বন্দর থানায় মামলা হয়। রনি জাফর গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলায় হয়। পরে উভয় গ্রুপ পূনরায় মারামারিতে লিপ্ত হয়। মেহেদী বাবু গ্রুপের হামলায় কুদ্দুছ নামে এক পান ব্যবসায়ী নিহত হয়। এর কয়েক ঘন্টা পর মেহেদী আত্বগোপনের উদ্দেশ্যে রিক্সাযোগে নবীগঞ্জ বিএনপি নেতা আবুল কাউছার আশাকে ফোন করে আশ্রয় চায়।
পরে প্রতিপক্ষরা মেহেদীকে বন্দর সিরাজদৌল্লাহ ক্লাবের সামনে পথরোধ করে গনপিটুনী দিয়ে মারাত্নক জখম করে। স্বজনরা খবর পেয়ে হাসপাতাল নিয়ে গেলে ডাক্তার মৃত ঘোষনা করে।
বন্দরে আধিপত্ত বিস্তারে এক রাতে দু্ই খুনের ঘটনায় উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। এ পর্যন্ত উভয় পক্ষের মোট ১৪ জন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় তল্লাশী চালিয়ে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ধারালো সুইচ গিয়ার উদ্ধার করা হয়েছে।
এলাকাবাসী সুত্রে জানা গেছে,হান্নান সরকার সমর্থিত বাবু একজন মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশের তালিকাভুক্ত অপরাধী। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ৪/৫টি মামলা রয়েছে। বাবু ও মেহেদী বাহিনীকে প্রশ্রয় দেন বিএনপির বহিস্কত নেতা ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর হান্নান সরকার ।
তার আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তারা অপ্রতিরোধ্য। এমন কোন অপকর্ম নেই তারা করে না। অপরদিকে আবুল কাউছার আশা সমর্থিত রনির ছেলে রায়হান একজন পেশাদার ছিনতাইকারী ও মাদক ব্যবসায়ী। রায়হানের রয়েছে শতাধিক কিশোর বাহিনী। নেতার আশ্রয় প্রশ্রয়ে রনি জাফর গ্রুপের সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠে।
নাম না প্রকাশের শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, বন্দরে শাহীমসজিদ, দত্তবাড়ি, বউবাজার, হাফেজীবাগ, রেললাইন এলাকা এখন দুষিত এলাকা। বেশির ভাগ ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত।
নামে কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তাঁরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে সহায়তা, ইন্টারনেট সংযোগ, কেব্ল টিভি (ডিশ) ব্যবসা ও ময়লা–বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি করা, হামলা, মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত।
বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী বলেন, বন্দরে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে নিহত আব্দুস কুদ্দুস হত্যা মামলায় হান্নান সরকার ও অপর তিনজন এজাহারনামীয় আসামি।
তথ্য ও প্রযুক্তির সহযোগিতায় গাজীপুরের টঙ্গিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে দুই হত্যা মামলায় ১৪ জন গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।