
বরেণ্য অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী সদ্য প্রয়াত। কিন্তু তার অসংখ্যক স্মৃতি রয়ে গেছে। রয়ে গেছে না বলা অনেক কথা। যা তার জীবনদশায় প্রকাশ হয়নি। আজ প্রকাশিত হলো-‘কবরীর না বলা কথা’ শেষপর্ব। “কবরীর পছন্দ, অপছন্দ”। লিখেছেন সাংবাদিক বিল্লাল হোসেন রবিন।
যখন খুব ভালো থাকি। ভালো ভালো খাই। বাইরে প্রচন্ড গরম আমি এয়ারকন্ডিশনের ভেতর বসে আছি। তখন মনে হয় আমার থেকে কত অসুখি মানুষ আছে। আমি কত সুখি। তাদের জন্য কষ্ট লাগে। রাস্তার মধ্যে যখন দেখি রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত ছোট ছোট বাচ্চারা নোংরা কাপড় পড়ে মার্কেটের সামনে ঘুরছে। আর আমরা দামী দামী গাড়ি নিয়ে শপিং করি। আসলে ওদের মেন্টালিটি এমন হয়েছে যে, যদি বলি চল আমার সঙ্গে খেতে দিব। কাপড় দিব। স্কুলে পাঠাবো কিন্তু ওরা আসে না। তখন আমার মনে হয় ওদের মেন্টালিটিটা কী নষ্ট হয়ে গেল? ক্ষুধার জন্য ধরে নিলাম ওরা খাবার পাচ্ছে ওখান থেকে। কিন্তু ওদের যে মানসিক বিকাশ দরকার। সেটা তো হচ্ছে না। এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বললেন সারাহ বেগম কবরী।
তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিগতভাবে গ্রীণ ভেলী ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালাই। আমরা ডোনারও। ২০০১ সাল থেকে কাজ করছি। ফাউন্ডেশন থেকে প্রতিবন্ধি বাচ্চাদের কাউন্সিলিং করি। এবং তাদের আর্থিক সহযোগিতা করি। প্রতিবন্ধী সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় একটা স্কুল আছে। ওদের আমি কম্পিউটার দিয়েছি। কাপড় দিয়েছি। এগুলো ফাউন্ডেশন থেকে দিয়েছি। ভব্যিষ্যতেও এ অটস্টিক ও প্রতিবন্ধি শিশুদের নিয়ে কাজ করতে চাই। আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি, কক্সবাজারে যে পর্যটন হচ্ছে। সেখানে সিনেপ্লেক্স করতে চাই। পর্যটকদের আকর্ষন করার জন্য। সমুদ্রে সিনেপ্লেক্স হলে পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়া যাবে। অনুমতি পেলে এইটা এবং আমার ফাউন্ডেশন নিয়ে থাকতে চাই।
কবরী বলেন, স্বপ্ন ছিল এমপি হব, তা বাস্তবায়ন হয়েছে। আর একটা স্বপ্ন হচ্ছে আমার প্রতিবন্ধী স্কুলটা। আমি নির্দেশনা দিয়েছি আমার ছেলেদের আমার মৃত্যুর পর আমার ভাগের সম্পূর্ন টাকাটা ফাউন্ডেশনে দান করে দেয়ার জন্য। এবং তারা যে যেখানে কাজ করছে সে উপার্জন থেকে একটা ডোনেট করবে। একটা ফান্ড হলে আমরা একটা ওয়েব সাইট থাকবে। সে ওয়েব সাইটে যারা যারা যোগাযোগ করবে তাদের ওই অর্গানাইজেশনে আমরা আর্থিক সহায়তা দিতে চাই।
তিনি বলেন, যাদের বাচ্চা অটিজম, এই বাচ্চাগুলো কোনদিন ভালো হবে না। এই বাচ্চারা কীভাবে দুমুঠো খেয়ে ভালো থাকবে। এদের টাকাটা যাতে আত্মসাত না হয়। এদের সেবায় যেন টাকাটা পরিপূর্ণভাবে ব্যয় হয়। মা বাবা মারা যাওয়ার পরে এই বাচ্চাগুলি কোথায় যাবে? সম্পদ. বাড়ি-ঘর রেখে গেলে আত্মীয়স্বজন তাদের মেরে ফেলবে। আল্লাহ যেন ওই আত্মীয় স্বজনদের মনের ভেতর আলো দেন, মা-বাবা মারা যাওয়ার পর অটিজম বাচ্চারা যেন দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারে, সেই সহায়তা যেন করে। এই বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমরা কাজ করছি। মানুষের মনে যেন একটা জায়গা হয় এই বাচ্চাগুলির জন্য। এদের প্রতি যেন কোন অবহেলা না করে। অটিজম বাচ্চাদের মায়েদের মুখে যাতে হাসি ফোটে।
নিজের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী বলেন, নিজের এবং দেশের একটা ভালো খবর, বাইরে থেকে ভালো একটা সাহায্য, নিজের ছবি বা কাজের প্রশংসা শুনতে ভালো লাগে। আমার ছেলেরা যখন ভালো রেজাল্ট করে, আমি যখন সেমিনারে যাই, তখন খুব ভালো লাগে। আমি একজন প্রতিনিধি হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলছি।
কবরী বলেন, সবাইকে নিয়ে আড্ডাবাজিটা খুব পছন্দ করি। সবাইকে নিয়ে দুরে কোথায়ও বেড়াতে যাই। সেখানে পিকনিকের মতো করে খাওয়া-ধাওয়া আর আড্ডা দিতে অনেক বেশি ভালো লাগে। আমি অতীতকে মনে রাখি না। যেমন কারো সঙ্গে যদি কোন কারণে মান অভিমান হয়, তাহলে সেটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করি। জীবনটা কয়দিনের?
খাবারের মধ্যে দেশি খাবার বরাবরই পছন্দ। চুলার পাড়ে বসে মা যখন চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা বানাতেন খেজুরের গুড় দিয়ে চুলার পাশে বসে খাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ সেটা কী পেস্টি, আর পিৎজাতে পাওয়া যায়? সো দেশীয় খাবার বরাবরই পছন্দ। বিদেশী খাবার তো ওয়ান টাইম। বড় মাছ পছন্দ। তবে সব সময় না। ঝাল অনেক পছন্দ। রান্না করতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন করি না।
কবরী বলেন, আফ্রিকা আর চায়না ছাড়া আর সব দেশই ভ্রমন করেছি। পছন্দের পোশাক শাড়ি। তবে ইদানিং ওয়েস্টার্ন কাপড় পছন্দ করি। কারণ একটা প্যান্ট আর শার্ট পড়েই চলা যায়। আর শাড়ি পড়ে বড় বড় এয়ারপোর্টে হাটা যায় না। অনেক দুর হাটতে হয়। শাড়ি পেছিয়ে যায়। এই বিড়ম্বনা দুর করতে আমি শাড়ি পড়ি কম।
মেকাপ নিয়ে বলেন, জীবনের শুরুটাই তো হয়েছে গাড় মেকাপ আর সাজসজ্জার মধ্য দিয়ে। তবে ব্যবহার করার চেয়ে দেখতে বেশি ভালো লাগে। কারা তৈরী করেছে। কোন ব্রান্ড। ইত্যাদি ইত্যাদি।
পরিশেষে বরেণ্য এই অভিনেত্রী বলেন, বাবা-মার স্বপ্ন পুরন হয়েছে। আমি কবরী হয়েছি এটাই তাদের স্বপ্ন ছিল। চলচ্চিতে আদর্শ সুচিত্রা সেন, উত্তম কুমার। রাজনীতিতে আদর্শ মিথন গান্ধি ও ইন্দ্রাগান্ধি। আর একজন পুরিপূর্ণ ও বহুগুনের মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমার রাজনৈতিক অনুপ্রেরনা। ধন্যবাদ আপা দীর্ঘ সময় কথা বলার জন্য। তোমাকেও ধন্যবাদ রবিন।
আরও পড়ুন :“আমি পারলে তো তাঁর প্রেমে পড়ে যাই”