নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

বৃহস্পতিবার,

২৮ আগস্ট ২০২৫

নারায়ণগঞ্জে পরিবেশ সুরক্ষায় সিটিপি ও  সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর জোর

নারায়ণগঞ্জ টাইমস

প্রকাশিত:১৭:৫৭, ২৭ আগস্ট ২০২৫

নারায়ণগঞ্জে পরিবেশ সুরক্ষায় সিটিপি ও  সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর জোর

নারায়ণগঞ্জের শিল্প দূষণের বাস্তবচিত্র অনুধাবন, প্রতিরোধের উপায় এবং সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নির্ধারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র উদ্যোগে ‘নারায়ণগঞ্জের পরিবেশগত অধিকার সুরক্ষায় শিল্প দূষণ রোধ ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।


বুধবার (২৭ আগস্ট) দুপুরে নগরীর আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন। সভায় বক্তারা শিল্প ও নগরায়ণের কারণে পরিবেশ, কৃষি, স্বাস্থ্য এবং নদ-নদীর ওপর ভয়াবহ প্রভাবের কথা তুলে ধরেন এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। 


বেলার প্রোগ্রাম অ্যান্ড ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর এ এম এম মামুন তার উপস্থাপনায় বলেন, ‘নারায়াণগঞ্জে ধারণক্ষমতার বাইরে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। শিল্প বর্জ্যের কারণে অন্যতম নদী শীতলক্ষ্যা এখন তৃতীয় দূষিত নদী। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জে কোনভাবেই নতুন শিল্পকারখানার অনুমতি প্রদান ঠিক হবে না।’ তিনি শিল্প দূষণের কারণে বায়ু ও মাটি দূষণের চিত্র তুলে ধরেন।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের প্রতিবেদন উল্লেখ করে তিনি জানান, প্রতি বছর নারায়ণগঞ্জে এক শতাংশ কৃষিজমি অকৃষি খাতে হারিয়ে যাচ্ছে। গত ১০ বছরে সদর উপজেলায় ৫৭১ হেক্টর জমি কমে গেছে। ‘পরিবেশ দূষণের কারণে স্থানীয়রা নানা দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং কৃষকরা পেশা পরিবর্তন করছে,’ যোগ করেন তিনি।


প্রধান অতিথি মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘শিল্প দূষণ রোধে সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (CETP) স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ছাদ বাগানসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত উদ্যোগকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।’ 


নারায়ণগঞ্জের ড্রেনেজ সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, মানুষ সরাসরি ড্রেনে বর্জ্য ফেলে। এজন্য জনগণের সচেতনতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুভ আহমেদ বলেন, ‘শিল্প দূষণের একটি প্রধান পরিণতি হল বিভিন্ন জলাশয়, খাল ও নদী দূষণ। তবে জলাবদ্ধতার জন্য শিল্প দূষণ একা দায়ী নয়, খালের ওপর অনুমোদনহীন সাঁকো ও বাজার বর্জ্যও দায়ী। খালের উপর অনুমদনহীন সাঁকো বানানো হয় যা পানির প্রবাহ কমিয়ে দেয়। নাগরিক হিসেবে আমরা সচেতন না। আমরা নিজেরা খাল ভরাট করে ফেলি। যার ফলে জলবদ্ধতা তৈরি হয় । দেখা যায় পানি বাহিত রোগ।’


তিনি জানান, ৯টি খাল পুনঃখনন করা হয়েছে এবং সিটিপি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জনসচেতনতা এখন আমাদের প্রধান কাজ। এজন্য সাইনবোর্ড, লিফলেট ও মাইকিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে জানাতে হবে যেন ময়লা না ফেলে। পাশাপাশি কেউ যদি ময়লা ফেলে, তবে তার বিরুদ্ধে জরিমানা ও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।


মা ও শিশু কল্যাণের সভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস ঝুনু বলেন, “নারায়ণগঞ্জ শহরে ড্রেনেজ লাইন নেই। বর্জ্য অরক্ষিত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রাখা হয়।”


বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি জালাল ভূঁইয়া বলেন, “মেঘনা ইকনমিক জোন ৫০০ একর জমি দখল করে স্থাপন করা হয়েছে। এটি উচ্ছেদে সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন। নাগরিকদের যুক্ত করে সম্মিলিতভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে।”


ব্যবসায়ী ও সংগঠক মহাম্মাদ আনিস বলেন, “শিশুদের পরিবার থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শিক্ষা দিতে হবে। শহরের বাইরে সিটিপি সহ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক করতে হবে।”


জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সহকারী প্রধান আহমাদ শামস কাদির বলেন, “শিল্প প্রতিষ্ঠানের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। ৩আর টেকনোলজি ব্যবহার করতে হবে। সামগ্রিকভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার বিকল্প নেই।”


বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক মুহাম্মাদ ইসমাইল হুসসাইন বলেন, “শহরের ভেতর ৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান খালে বর্জ্য ফেলছে যা পরে সরাসরি নদীতে যেয়ে পরে । জনগণের সোচ্চার থাকার কারণেই নদীগুলো এখনো টিকে আছে।”


এলজিইডি’র উপজেলা প্রকৌশলী ইয়াসির আরাফাত বলেন, “ওয়েস্ট উৎপাদন বন্ধ করা যাবে না, তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আমরা প্লাস্টিক ওয়েস্ট রিসাইকেল করে রাস্তায় কারপেটিং প্রকল্প নিয়েছি।”


কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. উমার ফারুক বলেন, “পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সঠিকভাবে বর্জ্য অপসারণ করে না।”


জেলা পরিষদের উপসহকারী প্রকৌশলী রতন চন্দ্র সরকার বলেন, “জেলা পরিষদ বর্জ্য নিষ্পত্তির ভ্যান সরবরাহ করেছে। ভ্রাম্যমাণ ডাস্টবিন স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে, তবে সচেতনতার অভাবে শহরের ড্রেনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মহাম্মাদ জহিরুল হক বলেন, “বতমান অবস্থা কৃষির জন্য ভয়াবহ। নারায়ণগঞ্জের সবজিতে সহনীয় মাত্রার বেশি ক্যাডমিয়াম পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত কৃষিজমি কমে যাওয়ায় উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি দূষণের কারণে কৃষিজমির উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং ভারী ধাতু খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।”


তিনি বলেন। তিনি আরও যোগ করেন, কীটনাশক কমানো এবং পলিথিন ব্যবহারের প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করতে হবে । সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন।”


নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক সোহেল আখতার বলেন, “নারায়ণগঞ্জ ঐতিহাসিকভাবে শিল্প এলাকা। ইটিপি ছাড়া কোন প্রকল্পের অনুমতি দেওয়া হয় না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় প্রতিনিধি ও তরুণ সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”


পরিবেশ অধিদফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর এ এইচ এম রাশেদ বলেন, “৪২টি প্রতিষ্ঠান বাদে বাকিরা ইটিপি স্থাপন করেছে। তবে লাইসেন্স ছাড়া অনেক কারখানা চালু রয়েছে। শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন জরুরি।”


সভায় আরও বক্তব্য রাখেন সৈয়দ আহমেদ আলি (সিনিয়র সহকারী সচিব, বিজিএমইএ), মোহাম্মাদ ওয়ালিউল্লাহ (সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, শিল্প পুলিশ-৪, নারায়ণগঞ্জ)।

সম্পর্কিত বিষয়: