
নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকা। একপাশে জেলা প্রশাসক কার্যালয়, অন্যপাশে জেলা রেজিস্ট্রি অফিস। এমন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরের মাঝেই গড়ে উঠেছে ভয়াবহ মাদক স্পট সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে চলে মাদকের প্রকাশ্য বেচাকেনা।
মাদক যেন এখন আর গোপনে নয়, বরং বাজারে সবজির মতো বিক্রি হচ্ছে। এ যেন মাদকের প্রকাশ্যে মাদকের হাট!
এই স্পটের বিষয়ে পূর্বেও একাধিকবার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত অভিযান হয়নি। বরং কিছুটা চাপ এলে মাদক কারবারিরা স্থান পরিবর্তন করে।
সম্প্রতি আয়কর অফিসের সামনে জিএনজি স্ট্যান্ড এলাকায় নতুন করে গড়ে উঠেছে আরেকটি স্পট। ফলে প্রশাসনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন নাগরিকরা।
ইসদাইর ৬ নং ওয়ার্ডের মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে এলাকায় মাদকের বিস্তার আরও বেড়েছে। আগে সীমিত আকারে চললেও এখন এটি রীতিমতো প্রকাশ্য ব্যবসা।
একজন স্থানীয় বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও আমরা এমন ভয়াবহ মাদক দেখতে পাইনি। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার পর মাদকের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। পরিবার নিয়ে এখানে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
আরেকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাসিন্দা জানান, এই ব্যবসার সঙ্গে বিএনপির কিছু প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা-কর্মীর যোগসূত্র রয়েছে। তাদের ছত্রছায়া থাকায় সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
গোপন সূত্রের দাবি, মাদক কারবারিদের অনেককে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত চলাফেরা করতে দেখা যায়। এমনকি দলীয় মিটিংয়েও তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
একজন বিএনপি কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের দল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শের। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী লোক বিএনপির নাম ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা করছে। এর ফলে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমরা শিগগিরই তাদের নাম প্রকাশ করব।
এলাকার সাধারণ মানুষ বলছে, যারা এই ব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলে তারা হামলার শিকার হয়। দেশীয় অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে মাদক ব্যবসায়ীরা। এর ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতেও ভয় পাচ্ছে।
প্রশাসনিকভাবে এ পর্যন্ত মাদকবিরোধী কোনো বড় অভিযান হয়নি। প্রশাসন চাইলে চিরুনি অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করতে পারত বলে মনে করছেন সচেতন মহল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—কেন প্রশাসন নিরব?
অনেকে মনে করছেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থেকে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা, তাই পুলিশও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না বা নিতে চাইছে না।
স্থানীয়দের মতে, মাদকের কারণে যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা আসক্ত হয়ে পড়ছে, বেড়ে যাচ্ছে অপরাধ। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, পারিবারিক অশান্তি—সবকিছুর পেছনেই মাদককে দায়ী করছেন তারা।
একজন অভিভাবক জানান, আমাদের ছেলেরা রাতে বাড়ি ফেরে না। মাদকের নেশায় তারা চুরি করে, মারামারি করে। পরিবার ভাঙছে। সমাজ অস্থির হয়ে পড়ছে।
সচেতন নাগরিকদের দাবি, খাল-বিল পরিস্কার করার আগে সমাজ থেকে মাদক পরিষ্কার জরুরি। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে না তুললে প্রশাসনের পক্ষে একা সফল হওয়া সম্ভব নয়।
এজন্য রাজনৈতিক নেতাদেরকেও নিজেদের দলে থাকা মাদক ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে বের করে দেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
সবাই এখন এক প্রশ্ন করছে—এই মাদক ব্যবসার আসল হোতা কারা?
কে সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা প্রশাসনকে অকার্যকর করে রেখেছে? অনুসন্ধান সূত্র বলছে, স্থানীয়ভাবে কিছু বিএনপি নেতা-কর্মীর সম্পৃক্ততা আছে। তবে এর পেছনে আরও বড় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে কিনা, তা জানতে আরও অনুসন্ধান প্রয়োজন।
ফতুল্লা থানার অফিসার ইনচার্জ শরিফুল ইসলাম জানায়, আমরা বিষটি অবগত হয়েছে , দ্রুত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
নারায়ণগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুর কাছেই যখন প্রকাশ্যে মাদকের হাট বসে, তখন প্রশ্ন ওঠে—রাষ্ট্রযন্ত্র কি অকার্যকর হয়ে পড়েছে?
প্রশাসনের বার বার অভিযানের পরেও কিভাবে প্রকাশ্যে মাদকের বেচাকেনা হয় তাও ডিসি ও এসপি অফিসের সামনেই এই নিয়ে হতাশ সাধারণ মানুষ।
এলাকাবাসীর প্রত্যাশা—রাজনৈতিক ছত্রছায়া ভেঙে দ্রুত চিরুনি অভিযান চালানো হোক। না হলে অচিরেই এই শহর মাদকের নগরীতে পরিণত হবে।