করোনাভাইরাসের আগেকার কথা। ঢাকার ধানমন্ডির বাসিন্দা অ্যানি অ্যাপে ক্যাব বুক করেছিলেন মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাবেন বলে। মাধ্যমিকের প্রথমদিন ছিল। গাড়ি থেকে নামার পর মেয়ের মুখে অস্বস্তির ছাপ দেখে মা জানতে চান কী হয়েছে?
মেয়ে জানায়, গাড়িতে বসে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গাড়ির ভেতর বাইরের শব্দ, গাড়িতে চলতে থাকা গান, আর ড্রাইভারের টানা মোবাইল কথোপকথনে তার মনসংযোগের চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
পথে-ঘাটে শব্দ বিস্ফোরণ
এমন ঘটনা নজিরবিহীন নয়। এমন শব্দ বিভ্রাটে পড়তে হয় প্রায় সকলকেই। শুধু ক্যাব কেন? প্রাইভেট কার, ট্রেন-বাস-অটো, সর্বত্রই শব্দদৈত্যের থাবা বসতে পারে যখন-তখন। আর সব মিলে বেশ খানিকটা কোলাহলও সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে গাড়ি প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এই শব্দ দূষণের কারণেই। এখন গাড়িসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক শব্দের লাগামহীন ব্যবহার সত্যিই বহু মানুষের কাছে অত্যন্ত সমস্যার!
মফস্বলে শব্দের উৎপাত মাত্রাছাড়া! ট্রেনে-বাসে-অটোতেও ব্লু-টুথ স্পিকার বক্স বাজিয়ে চালানো হয় হিন্দি গান। কোন যাত্রীর মনের কী পরিস্থিতি, তা বোঝার উপায় থাকে না! যারা বিষণ্নতায় আক্রান্ত, যারা হার্টের অসুখে ভুগছেন, যারা পড়াশোনা পরীক্ষা নিয়ে রয়েছেন। তাদের কাছে এই যান্ত্রিক শব্দের ব্যবহার এক ধরনের নির্যাতন।
তাই সাইলেন্ট কমিউটিং বা যাতায়াতের সময় নীরবতা আমাদের সুস্থভাবে যাতায়াতের জন্যও বিশেষ জরুরি। মাস কয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় ‘কমিউটার সমীক্ষা’ হয়। মূলত নিত্যযাত্রীদের উপর চালানো হয় এই সমীক্ষা। তাতে দেখা যায়, সমীক্ষার আওতায় থাকা একাধিক অফিসকর্মী জানান, যাতায়াতের সময়টা শব্দবিহীন কাটালে কাজে অনেক বেশি মনসংযোগ করা যায়।
শব্দ বিস্ফোরণ ঠেকাতে
অনেকেই যাতায়াতের পথে শব্দ বিস্ফোরণ পছন্দ করেন না। তাদের জন্য সারাবিশ্বে সাধারণ যাত্রী-পরিবহনকারী পাবলিক যানেও সাইলেন্ট জোন তৈরি করা হচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোতে ট্রেনে সাইলেন্ট কম্পার্টমেন্ট রয়েছে। যারা যাতায়াতের পথে শব্দবিভ্রাট এড়িয়ে যেতে চান, তারা বেছে নেন এই সাইলেন্ট কম্পার্টমেন্ট। এখানে গান তো দূরের কথা, ফোনে কথা বলাও বারণ। অধিকাংশ যাত্রীই যাতায়াতের পথে বই পড়েন অথবা চুপচাপ বসে থাকেন।
পাশের যাত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনাও এখানে অ্যাটিকেট বা শিষ্টাচার বিরোধী। ইউরোপের দেশগুলোর মতো এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও অনেক ক্ষেত্রেই সাইলেন্ট কমিউটিং-এর ধারণা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এখন ব্যস্ত শহরে শুধু বাড়ি গাড়ির স্বপ্ন নয়। নিজের শব্দবিহীন গাড়ি না থাকলে যে কতোটা ভোগান্তি সেটা ভুক্তভোগী মানুষ মাত্রই জানেন। ব্যস্ত শহরের এমনতরো বিলাসবহুল স্বাস্থ্য সচেতন এলিট মানুষের কথা মাথায় রেখে গেলো দশ বছর ধরে সহজে বহনযোগ্য এবং কার্যকর শব্দ বিহীন বাহন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি।
শব্দবিহীন সাইলেন্ট কম্পার্টমেন্ট সুবিধা নিয়ে গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি বের করে চলেছে নানান শব্দ বিহীন গাড়ি। গাড়ি তৈরির সময়ই, নির্মাতা কোম্পানি চেষ্টা করে গাড়িকে কম শব্দ সৃষ্টিকারী করে তৈরি করার। তবে সেটা পারার একটা সীমাব্ধতা রয়েছে। গাড়ির বিভিন্ন অংশ থেকে নানান রকম শব্দ আসবেই।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যায় প্রযুক্তি। আরও উন্নয়নশীল হয়- নতুন আবিষ্কার উদ্ভাবন হয়। পুরাতনদের উন্নীত করা হয়। এবার গাড়ির ভেতরে শব্দ দূষণ রহিত করে সাইলেন্ট জোন তৈরিতে অন্য সমাধান খুঁজে পাওয়া গেল। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন প্লাস্টিকের একরকম ফোম। যা গাড়ির নানান অংশের সঙ্গে আটকিয়ে শব্দ শোষণের ব্যবস্থা করা হয়। এই পলিউরেথেন ফোমের আনবিক গঠনে এমন পরিবর্তন আনা সম্ভব যাতে এটা বিশেষ বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শোষণ করবে।
জিনিসটার রাসায়নিক গঠন মূলত পলিমার চেইন। পলিমারাইজেশন প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত কম দীর্ঘ চেইন পাওয়া যায়। আর তাতে ফোমটা হয় বেশি দৃঢ় প্রকৃতির। ফোম যতো দৃঢ় হবে, অধিক ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ এটা শোষণ করতে পারবে।
এভাবে বিভিন্ন রকম ফোম অর্ডার মতো তৈরি করে একশত থেকে এক হাজার হার্জের মধ্যে নানান ফ্রিাকোয়েন্সির শব্দ বিলুপ্ত করা যায়। গাড়ির ইঞ্চিন, বডি, এগজস্ট ইত্যাদি নানান অংশের যতো রকম বিরক্তিকর শব্দ রয়েছে তার সবই এভাবে নাই করে দেয়া যায়।
আইসিআই কোম্পানি এরকম শব্দের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর নানান ফোম তৈরি করেছে এবং তার তলদেশকে এমন আঠালো করে তুলেছে যাতে এটা সরাসরি গাড়ির নানান অংশের সঙ্গে সেট করে দেয়া সহজ হয়। উভয়ের মধ্যে একটুকুও গ্যাপ না থাকে। তবে টায়ার এবং টায়ারের ঘর্ষণের শব্দটা আলাদা।
অটো ইন্ডাস্ট্রিগুলো যুগের পর যুগ ধরে শব্দবিহীন নীরব গাড়ি তৈরি চেষ্টা করে যাচ্ছে। এবার বাজারে এলো আসল শব্দবিহীন পরিবেশ বান্ধব গাড়ি- ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল বা ইভি। এগুলো প্লাগ ইন হাইব্রিড গাড়ি। বাইরে থেকে গাড়িটা দেখতে মনে হবে স্থায়ী পরিবর্তন বলতে তেমন নতুন কিছু নেই। কিন্তু না। শব্দবিহীন নীরব গাড়ি হিসেবে বর্তমান বাজারে সব চালকই এই পরিবেশ বান্ধব এই ইলেকটিক্র ভেহিক্যাল বা ইভি পছন্দের গাড়ি হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
ইভি গাড়ি নির্মাতা ‘বুইক আনক্ল্যাভ অ্যাভেনির’ তাদের গাড়িতে শব্দ ঝঙ্কার কমাতে লেমিনেটিং অ্যাকোস্টিক গ্লাস ব্যবহার করেছে। গাড়ির ড্যাশবোর্ড, হুড, দরজা, বডি ও চেসিসের সবখানে ইনসুলিন দ্রব্য ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে গাড়ির ভেতরের পুরোটা অতি নীরব কেবিনের মতো আরামপ্রদ অনুভূত হয়। যা এখন পর্যন্ত বের করতে পারেনি রোল রয়েস কোম্পানি।
অটোমোবাইল জগতে ‘বোস্ট ক্লিয়ার মোশন প্রযুক্তি’ এসময়ে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই প্রযুক্তি হচ্ছে একটা ক্ষুদ্র কম্পিউটার। গাড়ির প্রচলিত শক অ্যাবজরভারের বদলে এটা বসানো হয়। এর কাজ হচ্ছে- গাড়ি যখন উঁচু-নিচু খাদ বা পথের জ্যামিং ঢেউ পার হয় তখন একটুও শব্দ বা কম্পন হয় না।
চলন্ত গড়িটাকে সমান স্থিরভাবে ধরে রাখে। কোম্পানির ভাষ্যমতে, ‘গাড়ির জগতে এটাই বিশ্বের সবচেয়ে প্রথম ডিজিটাল চেসিস। এর সক্রিয় সাসপেনশন প্রযুক্তি বাইরের ঘর্ষণ ও নানারকম শব্দের উৎপত্তি কমায়। গাড়ির ভেতরটা লিভিং রুমের মতো নীরব পরিবেশ তৈরি করে। এতোটাই নীরব যে গাড়ি কখন কোন দিকে ঘুরছে কিছুই ঠাহর করার উপায় নেই।’
কোম্পানির বড় অংশীদার বিশ্বখ্যাত টায়ার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ব্রিজস্টোন। ব্রিজস্টোনের মার্কেটিং ম্যানেজার বিল থমসন বলেন, ‘ক্লিয়ার মোশন প্রযুক্তি’ আগামীদিনের ডিজিটাল গাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল।’ তবে গাড়ির সঙ্গে সমন্বয় করতে দরকার হবে ব্রিজস্টোনের ঝাঁকুনি বিহীন টায়ার।
কারণ এই টায়ারে সংযুক্ত রয়েছে বাতাসের চাপ নিয়ন্ত্রণের বিশেষ স্প্রিং প্রযুক্তি। ফলে গাড়ির ঘর্ষণ শব্দ কম বোধ হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, এখন ঘণ্টায় ২০০ মাইল গতিবেগের বুলেট ট্রেনে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে।
এতো সাধের শব্দবিহীন গাড়ি এতো কষ্টে এতোদূর রাস্তা এগিয়ে গেলো। তবুও আফসোস রয়েই গেলো। সবার মন পেলো না এই গাড়ি! শব্দবিহীন গাড়িতেও যে এতোটা অসুবিধা তা আগে কেউ খেয়াল করেনি। অসুবিধা কোথায়? বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘শব্দবিহীন গাড়ি অন্ধ আর বেহুশ পথচারীদের জন্য মারাত্মক বিপদজনক বৈকি!’ আর সে কথা ভেবে রাস্তার নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সম্প্রতি শব্দ বিহীন ইলেকট্রিক গাড়িতে বিপদজনক অ্যালার্ম সাউন্ড যুক্ত করে পথচারীদের সতর্ক করার ব্যবস্থা করতে প্রস্তাব করেছে।
শব্দবিহীন ইভি গাড়ির বাইরে বাড়তি একটা স্পীকার বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেক বিতর্কের পর অবশেষে ঘণ্টায় ১৮.৬ কি.মি. উর্ধ্বগতিতে থাকা অবস্থায় শব্দ বিহীন ইভি গাড়িতে বিপৎজনক অ্যালার্ম সাউন্ড ব্যবহার করার নির্দেশনাসহ সম্প্রতি বিলটি আইনে রূপান্তরিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হাইওয়ে সেফিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানায়, ‘এ কারণে তাদের পাঁচ লাখ ত্রিশ হাজার পরিমাণ ২০২০ সালের মডেলের গাড়িতে বাড়তি ওয়াটার প্রুফ ওয়ার্নিং সাউন্ড স্পিকার লাগাতে হবে।’ তবুও এতে দেশটিতে বছরে আড়াই হাজার সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতি ২৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হতে পারে।
কিন্তু সবার কাছে গাড়ির সব শব্দই যে অবাঞ্চিত, তা কি হয়? যেমন, যারা বহু দাম দিয়ে স্পোর্টস কার কিনেন, তারা সেটার ইঞ্জিনের বিশেষ গোঙানির বিকট গর্জন আওয়াজ চারিদিকে ছড়িয়ে খবর করে দিতে না পারলে তারা খুশি হবেন না। শব্দবিহীন ইভি গাড়িগুলো গ্যাসোলিনের বেশি ক্ষমতার ইঞ্জিনের মতো অতো তর্জন-গর্জন করে ওঠে না।
তাই এমন ক্রেতার আগ্রহ মেটাতে ইঞ্জিনের শব্দকে অক্ষুণ্ন রেখে অন্য শব্দগুলোই কমানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এখন শব্দবিহীন ইভি গাড়িগুলোতে নিজস্ব কিছু ‘সিগনেচার সাউন্ড’ স্পীকার বসানোর কাজ করছে। শব্দ বিভ্রাট নিয়ে তাই আর কোনো চিন্তা নেই।
আগামীদিনে গাড়ি ক্রেতারা শব্দবিহীন গাড়িসহ ইচ্ছেমতো নানান শব্দ বৈশিষ্ট্য সম্বলিত গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। ঠিক যেমন এখন নানান ফিচার সমৃদ্ধ অ্যান্ড্রয়েড গেজেট, স্মার্টফোন বা নানান রঙের নানান ব্র্যান্ডের গাড়ি ব্যবহার করা যায়।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।