নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪

রমযান ও ইফতার প্রসঙ্গ

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার 

প্রকাশিত:০১:০৩, ৯ এপ্রিল ২০২২

রমযান ও ইফতার প্রসঙ্গ

এই লেখাটি আমরা যারা সিয়াম পালন করি (রোযা রাখি) তাদের জন্য। আমি আমার স্বল্প অধ্যয়ন এবং নগণ্য জ্ঞান দিয়ে যতটুকু অনুধাবন করতে পেরেছি তাই লিখছি। মহান রব আমাদের ভুলভ্রান্তি শুধরে আমাদের ক্ষমা করুন। আমীন।

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা আল বাকারার ১৮৭ নং আয়াতের শেষাংশে বলেছেন, “অতঃপর রোযা পূর্ণ করো রাত্র পর্যন্ত।” এই আয়াতে বলা হয়েছে যে রাত না আসা পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করতে হবে। অথচ আমরা তার ১৫/২০ মিনিট পূর্বেই ইফতার করে ফেলি। এ প্রসঙ্গে অনেক মাওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন যে সন্ধ্যা রাতেরই একটা অংশ যা সূর্যাস্তের সাথে সাথেই শুরু হয়!

কিন্তু পবিত্র কোরআনে সূর্যাস্তকে ‘গুরুবেশ শাম্স’, সন্ধ্যা বুঝাতে ‘আছিল’, সূর্যাস্তের পরবর্তী রক্তিম পশ্চমাকাশকে ‘শাফাক্ব’ শব্দসমূহ দ্বারা বোঝানো হয়েছে।

সুরা ইনশিক্বাক ১৬ ও ১৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “আমি শপথ করছি সূর্যাস্তকালীন লালিমাযুক্ত আকাশের আর রাত্রির। এবং রাত্রিতে যা কিছুর সমাবেশ ঘটে তার।”

সন্ধ্যা যদি রাত্রির অংশ হতো তবে আল্লাহ সূর্যাস্তের লাল আভা আর রাত্রির শপথ আলাদাভাবে করতেন না। আসলে শাফাক্ব এর পরিসমাপ্তির পরেই লাইল বা রাতের শুরু।

রাত সম্পর্কে বা রাত্রির ব্যাখ্যা নিয়ে আমাদের কোন সন্দেহ যেন না থাকে সেজন্য মহাজ্ঞানী আল্লাহ নিজেই আল কোরআনে রাতের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। যেমন:

সুরা বনি ইসরাইলের ১২ নং আয়াতে বলা হয়েছে:

“আর আমি রাত্রি ও দিনকে দুটি নিদর্শন করেছি। রাত্রির নিদর্শনকে করে দিয়েছি নিস্প্রভ এবং দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকোজ্জ্বল।”

সুরা ইয়াসিনের ৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে:

“আর তাদের জন্য আরেকটি নিদর্শন হলো রাত, আমিই তার উপর থেকে দিনকে অপসারিত করি, ফলে তৎক্ষণাৎ তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।”

আল্লাহ সুবহানাল্লাহুতায়ালা সুরা আশ-শামস এর ৩ ও ৪ নং আয়াতে, সুরা আল লাইল এর ১ ও ২ নং আয়াতে, সুরা দোহা’র ১ ও ২ নং আয়াতে রাতের পরিচয় দিয়েছেন যে এটা সূর্যকে আচ্ছাদিত করে, ঢেকে ফেলে এবং তা নিঝুম-নিস্তব্ধ হয়।

পবিত্র কোরআনে এই লাইল বা রাত শব্দটি ১৬২ স্থানে উল্লেখ আছে।

তেমনিভাবে সুরা আল ফোরকান এর ৫ নং আয়াতে সন্ধ্যা বুঝাতে “আছীলা” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুরা নূর এর ৩৬ নং আয়াতে সন্ধ্যা বুঝাতে ‘আছল’, কিন্তু একই সুরার ৪৪ নং আয়াতে রাত বুঝাতে লাইল শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

তাই রাত কখনই সূর্যাস্ত বা সন্ধ্যা কিংবা সূর্যাস্তকালীন লালিমা নয়; এটা এমন এক সময় যে পরিপূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন যাতে দিনের আলোর উপস্থিতি নেই।

তাহলে মহান আল্লাহ আমাদেরকে কখন পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করতে নির্দেশ দান করেছেন তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি সহজেই।

এখন, পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যার সাথে আমরা হাদীস থেকেও এর সপক্ষে প্রমাণ পেতে পারি।

হুমায়দ ইবনে আব্দুর রহমান (রাঃ) হতে বর্ণিত,

“উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এবং উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) উভয়ে মাগরিবের নামাজ পড়তেন, এমন সময় তখন তাঁরা রাত্রির অন্ধকার দেখতে পেতেন। আর তা হতো ইফতারের পূর্বে। অতঃপর তাঁরা উভয়ে ইফতার করতেন।….” (মুয়াত্তা, ইমাম মালিক রঃ,৫ম সংস্করণ, রোযা অধ্যায়, হাদীস নং৮)

বুখারী শরীফের (ইফাবা, ৩য় খণ্ড নং ১৮৩৪) একটি হাদীস:

রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “তোমরা যখন এদিক (পূর্বদিক) হতে রাত্রির আগমন দেখতে পাবে তখন রোযাদার ইফতার করবে।”

বুখারীর অপর একটি হাদীসে রয়েছে:

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যখন রাত সে দিক থেকে ঘনিয়ে আসে এবং দিন এ দিক থেকে চলে যায় তখন রোযাদার ইফতার করবে।”

মুসলিম শরীফের একটি হাদীস:

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যখন রাত আসে, দিন চলে যায় এবং সূর্য অদৃশ্য হয়ে যায় তখন ইফতার করবে।” (মুসলিম, খণ্ড ৩ নং ২৪২৫; তিরমিযী ৩/৬৯৬, পৃষ্ঠা ৭০, ইফাবা প্রকাশিত)

আরেকটি হাদীস আমরা অনেকেই জানি এবং গুরুত্ব দিয়ে থাকি:

রাসূলুল্লাস (সাঃ) বলেছেন, লোকেরা সর্বদা কল্যাণের উপর থাকবে যতদিন তারা সত্ত্বর ইফতার করবে।”

এখন চিন্তাশীলদের কাছে আমার প্রশ্ন, সত্ত্বর মানে কি সময় হওয়ার আগেই? আরেকটু ভেবে দেখা দরকার যে, ইফতার করার ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করতে আমাদের জুড়ি নেই! তাহলে আমরা কোন কল্যাণের মধ্যে রয়েছি আজ? চারদিক যে যার মতো করে ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন করছে ইসলামকে। ইসলামের নামে নিজেদের মুসলমান দাবী করে অপর মুসলমানের শিরশ্ছেদ করছে, বোমাবাজি করছে, করছে লুটতরাজ। মিথ্যাচার আর ভন্ডামির লালন চলে পোশাকী আর গলাবাজিনির্ভর অপ্রকৃত ইসলামের ছত্রছায়ায়।

যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি।

উপরে উদ্ধৃত পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ ও হাদীস হতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে রাত্রির আগমন না ঘটলে ইফতার করা বৈধ নয়। এরপরও, কোরআনে লাইল বা রাত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ বলে যে সূর্যাস্তের সাথে সাথেই রাতের শুরু, তবুও ২০/২৫ মিনিট পরে যারা ইফতার করবে তাদের রোযা ঠিকই পূর্ণ হচ্ছে, কিন্তু রাতের আগমন বলতে সূর্যাস্ত ও শাফাক্ব এর পরের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কে যদি বুঝায় (এবং সেটাই আল কোরআন সত্যায়ন করেছে), তাহলে যারা সূর্যাস্তের পরপরই ইফতার করছে তাদের রোযা কি আদৌ হচ্ছে?

মুসলমানদেরকে রোযা রাত্রি পর্যন্তই পূর্ণ করে হবে। এক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুমকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। সুরা নিসা’র ৫৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, “হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সাঃ) এবং ‘উলিল আমর’-দের, এবং যদি কোন ব্যাপারে তোমাদের মতবিরোধ হয় তবে তোমরা আল্লাহ ও শেষদিনে বিশ্বাসী হও। ইহাই উত্তম ও পরিণামে প্রকৃষ্টতর।” এই ‘উলিল আমর’ কে বা কারা সে বিষয়য়ে অন্য আলোচনায় বলা হবে ইন শা আল্লাহ। আপাতত সূরা আল বাকারা’র ১৮১ নং আয়াতটি বলেই শেষ করতে চাই:

আল্লাহ বলেন, “অতঃপর ইহা (অর্থাৎ আল কোরআন) শোনার পরও যদি কেউ তা পরিবর্তন সাধন করে, তবে যারা পরিবর্তন করবে অপরাধ তাদেরই।”

তাই আসুন, আমাদেরকে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীরুতা অর্জনের জন্য মহান আল্লাহ যে রোযা আমাদের উপর ফরয করলেন, সেই আল্লাহর ভয়েই, তাঁর নির্দেশ অনুসারেই যেন আমরা রোযাগুলো পূর্ণ করি।

আল্লাহ সুবহানাল্লাহ আমাদেরকে ‘সরল পথ’ তথা সঠিক পথে চালিত করুন।