অবশেষে বন্দর উপজেলা নির্বাচনে দোয়াত কলম প্রতীকের ভরাডুবি হয়েছে। বন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা এম এ রশিদ দোয়াত কলম নিয়ে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। হুমকি-ধামকির পরও তার প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী আনারস প্রতীকের মাকসুদ হোসেন বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। দ্বিতীয় পরাজিত হয়েছেন এম এ রশিদ। তৃতীয় হয়েছেন চিংড়ী প্রতীকের প্রার্থী বিএনপি নেতা আতাউর রহমান মুকুল।
নির্বাচনের শুরু থেকে এম এ রশিদের প্রতিদ্বন্দ্বি দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুই সংসদ সদস্য, জেলা ও মহানগর আওয়ামী এবং সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের হুমকি-ধামকি ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল মাকসুদ হোসেন ও আতাউর রহমান মুকুলকে নির্বাচন থেকে দুরে রাখার। ব্যাপক বিষদাগার করা হয় তাদের নিয়ে। এমনও বলা হয়, মাকসুদ বিজয়ী হলে বন্দর উপজেলা মিনি পাকিস্তান হয়ে যাবে। কিন্ত ভোটাররা তাদের এই কথা আমলে নেয়নি। বিপুল ভোটে তারা মাকসুদ হোসেনকে বিজয়ী করেছে। এতে রাজাকার পুত্রের কাছে মুক্তিযোদ্ধার পরাজয় হয়েছে।
অভিযোগ ছিল, কেন্দ্র দখল করে এম এ রশিদের পক্ষে জাল ভোট দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা আছে। কিন্তু আইনশৃংখলা বাহিনীর কঠর অবস্থানের কারণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে এম এ রশিদের পক্ষে জাল ভোট দেয়ার সময় এক যুবক আটকও হয়। বন্দর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের লাউসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এম এ রশিদের পক্ষে দোয়াত কলম প্রতীকে জাল ভোট দেওয়ার সময় পোলিং এজেন্ট নাঈম ওরফে ওমর ফারুককে আটক করা হয়। পরে তাকে ৬ মাসের বিনাশ্রম সাজা দেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।
এদিকে এম রশিদের এমন ভরাডুবি নিয়ে বন্দর ও শহরে নানা কথা চাউর হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এম এ রশিদের পক্ষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের হুমকি-ধামকি এবং নদীর পশ্চিম পাড় থেকে বহিরাগতদের পুর্বপাড়ে গিয়ে লম্ফ-ঝ¤ফ দেয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি বন্দরের সাধারণ ভোটাররা। তাছাড়া নানা হুমকি-ধামকির পরও শেষ পর্যন্ত মাকসুদ হোসেন ও আতাউর রহমান মুকুল ভোটের মাঠে টিকে থাকায় ভোটারদের আস্থা অর্জন করেছেন তারা। ফলে এই দুইজনের মধ্যেই মূল লড়াই হয়েছে। এবং এম এ রশিদ তৃতীয় হয়েছেন। ১৫ বছর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এবং বন্দর-শহর আসনে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত সংসদ সদস্য থাকার পরও এম রশিদের চরম ভরাডুবিতে চুপসে গেছে স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও সহযোগ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এতে দৃশ্যমান হয়েছেন বন্দরবাসী তথা ভোটারদের কাছে এমএ রশিদ জনপ্রিয়তায় অনেক পিছিয়ে। তার শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ইমেজও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বন্দবাসীর কাছে।
ওদিকে বন্দরের আলোচিত দুর্ষর্ধ সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ খান মাসুদ ও তার বাহিনীর তৎপরতাও এম এ রশিদের ভরাডুবির পেছনে কাজ করে। প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী আতাউর রহমান মুকুলের এক সমর্থককে তুলে নেয়ার বিষয়টি ভোটের মাঠে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ভোটের দিন বন্দরের কুশিয়ারায় হাজী আব্দুল মালেক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করে ছাত্রলীগ নেতা হাসনাত রহমান বিন্দুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ। তারা কেন্দ্রে ঢুকতে না পেরে দফায় দফায় কেন্দ্রের বাইরে ও ভিতরে চকলেট বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভোটারদের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। যাতে ভোটার উপস্থিতি কম হয়। এবং সুযোগ বুঝে কেন্দ্র দখল করে দোয়াত কলমে সিল মারবে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্টাইকিং ফোর্স তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। এবং ছাত্রলীগের এমন কর্মকান্ড ভোটারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
এছাড়া এম এ রশিদ নিজেই স্বীকার করেছেন ২৫/২৬ বছর ধরে বন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তার একক নেতৃত্ব নিয়ে স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। এমনকি এম রশিদের আচরণও নেতাকর্মীদের কাছে বিষের মতো। ফলে উপরে উপরে তৎপরতা দেখালেও তারা জোরালোভাবে দোয়াত কলমের পক্ষে মাঠে নামেনি। এমনকি কোন কোন চেয়ারম্যান মাকসুদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে পরোক্ষভাবে আনারসের পক্ষে কাজ করেছেন।
অন্যদিকে যেহেতু আতউর রহমান মুকুল দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন এবং এম রশিদ বর্তমান চেয়ারম্যান। এই দুই জনেরই কার্যক্রম বন্দর উপজেলাবাসী দেখেছে। তাই তারা এবার নতুন একজনকে বেছে নিয়েছেন। তাছাড়া মাকসুদ হোসেনের বিপুল টাকার কাছে পর্দার আড়ালে নতজানু হয়েছেন প্রভাবশালী অনেকেই। আর টাকা পেয়ে প্রতিদান দিয়েছে একেবারে নিরিহ সাধারণ ভোটারা।
প্রসঙ্গত: নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয় পাটির সহসভাপতি মাকসুদ হোসেন (আনারস) বিজয়ী হয়েছেন। ৫৪টি কেন্দ্রে বুথের ফলাফলে তিনি ভোট পেয়েছেন ২৯ হাজার ৮৭৩। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি বন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা এম এ রশিদ (দোয়াত-কলম) পেয়েছেন ১৪ হাজার ৮৭৪ ভোট। বিএনপি নেতা আতাউর রহমান মুকুল (চিংড়ী) পেয়েছেন ১২ হাজার ৬২২ ভোট।
জেলা নির্বাচন অফিসার ও রির্টানিং কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ ইস্তাফিজুল হক আকন্দ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রঙ্গত: উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ৫৪টি কেন্দ্রের ৩৫৭টি ভোট কক্ষে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতীহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলে। মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৬৪ জন।