
নারায়ণগঞ্জবাসীর তীব্র ক্ষোভের মুখে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বর্ধিত বাস ভাড়া স্থগিত করেছে জেলা প্রশাসন। শুক্রবার (২২ আগস্ট) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম মিঞা স্বাক্ষরিত এক আদেশে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। ফলে এই রুটে ভাড়া পূর্বের মতোই ৫০ টাকা বহাল থাকবে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, অনিবার্য কারণে গত ২০ আগস্ট বন্ধন ও উৎসব পরিবহনের বর্ধিত ভাড়ার বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ রুটে বন্ধন ও উৎসব পরিবহনের ভাড়া আগের মতো বহাল থাকবে। আলোচনা সাপেক্ষে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এর আগে গত ২০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ’র উদ্যোগে এই সভার আয়োজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।
সভায় পরিবহন মালিকরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ভাড়া বাড়ানোর দাবি করেন। সভায় উপস্থিত সবাই সরকারি প্রজ্ঞাপন ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের হিসাব আলোচনা পর্যালোচনা করেন। পরবর্তীতে সবার পর্যালোচনা অনুযায়ী ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ভাড়া ৫০ টাকা থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৫৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি সপ্তাহের ৭ দিনই শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
পরিবহন মালিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে আগে বেসরকারি কয়েকটি পরিবহনের বাস চলাচল করলেও বর্তমানে সিটি বন্ধন পরিবহন ও উৎসব ট্রান্সপোর্টের শতাধিক বাস চলাচল করে।
এ পথে ৪৫ টাকায় নন-এসি বাসগুলোতে যাত্রী পরিবহন করলেও কোভিডের সময়ে বাস ভাড়া এক লাফে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়। পরে তা পাঁচ টাকা কমিয়ে ৫৫ টাকা করা হয়।
গত বছর গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জে বাস ভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে নারায়ণগঞ্জ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম। তারা আধাবেলা হরতালেরও ঘোষণা দেন।
পরে হরতালের একদিন আগে ১৬ নভেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান বাস-মালিক ও যাত্রী অধিকার ফোরামের সঙ্গে বৈঠক করে বাস ভাড়া কমিয়ে ৫০ টাকা নির্ধারণ করেন।
এই সিদ্ধান্তের নয় মাসের মাথায় বাস ভাড়া পুনরায় বাড়ানো হয়। যদিও নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা পথে সরকারি পরিবহন বিআরটিসির যেসব বাস চলে সেগুলোর ভাড়া ৪৫ টাকা।
এ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সংগঠন ও যাত্রী অধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তীব্র বিরোধিতা করে ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, বাস ভাড়া বৃদ্ধি নারায়ণগঞ্জের মানুষকে হতাশ করেছে। এই অনৈতিক ভাড়া বৃদ্ধি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, তেল ও ডিজেলের দাম কমলেও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপনও নেই। এটা অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এছাড়াও তিনি এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন।
গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়কারী তরিকুল সুজন বলেন, যাত্রী সাধারণের স্বার্থ বিবেচনা না করে কেবল বাসমালিকদের দাবিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের সঙ্গে অন্যায়।
ওয়ার্কিং ফর বেটার নারায়ণগঞ্জের সমন্বয়ক ও নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, জ্বালানি মূল্যের স্থিতিশীলতা থাকা সত্ত্বেও বাস ভাড়া অযথা বৃদ্ধি করা হলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হবে।
বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীরা ও নিম্ন-আয়ের মানুষজন প্রতিনিয়ত পড়াশোনা ও কর্মস্থল পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য এই ভ্রমণ পরিসর ব্যবহার করেন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে।
ইসলামী আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, বাসভাড়া বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা দেখিনি। কিন্তু বিরোধীতা থাকা সত্ত্বেও একচেটিয়াভাবে বাসভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাস-মালিকদের দাবি অনুযায়ী এখন যেহেতু কোনো চাঁদাবাজি হয় না, তাহলে বাসভাড়া বাড়ানোর তো কোনো কারণ নেই। আমরা বাসভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদ জানাই।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের জেলা সভাপতি ফারহানা মানিক মুনা বলেন, এটা একটি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত। কোনো খচর বৃদ্ধি ছাড়াই ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক মেহরাব হোসেন প্রভাত ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বলেন, বাস ভাড়া বাড়ানো একটা গণবিরোধী সিদ্ধান্ত।নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয় বাড়িয়ে, সাধারণ মানুষকে আর্থিক চাপের মুখে ফেলা মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের মহানগর সাধারণ সম্পাদক অমিত হাসান বলেন, ওসমান পরিবারের চাঁদাবাজির বলয় থেকে নারায়ণগঞ্জের পরিবহন মুক্ত হওয়ার পর আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম বাস ভাড়া কমানোর দাবিতে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রশাসন ও বাস মালিক সমিতি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রূটের ভাড়া ৫ টাকা কমিয়ে ৫০ টাকা এবং শিক্ষার্থীদের হাফপাস কার্যকর করে।
কিন্তু বছর ঘুরতেই আবারও ৫ টাকা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত একটি নেক্কারজনক ঘটনা বলে মনে করছি। অথচ জ্বালানির দাম বাড়েনি। তাহলে কোন অজুহাতে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত! তবে কি, পরিবহনে আবার নতুন সিন্ডিকেট এর কালো হাত পড়লো?
এদিকে এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন। তারা ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বলেন, ভাড়া কমানো না হলে শহরে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
অন্যদিকে শুক্রবার ও শনিবার কর্মসূচি ঘোষণা করে গণসংহতি আন্দোলন ও যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম।
এদিকে বাসভাড়া বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচনা ও তীব্র বিরোধিতা ও লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচীর ঘোষণা আসতে থাকলে শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসক বাস ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন।