ভূমিকম্পের তীব্রতায় কেঁপে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ। ভবনগুলো তীব্রভাবে দুলতে থাকে। আতঙ্কিত মানুষজন দ্রুত ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন।
এরই মধ্যে জেলার পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার স্কুলসহ বহু ভবনের দেওয়াল, সিঁড়ি ও কলামে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। দৃশ্যমানভাবে হেলে পড়ে কয়েকটি ভবন, ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক সেমিপাকা ও পাকা ভবন।
অন্যদিকে দেয়াল ধসে ধসে ফাতেমা নামে ১০ মাস বয়সের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় শিশুটির মা কুলসুম বেগম (২৬) এবং প্রতিবেশী জেসমিন বেগম (৩০) সহ বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।
এছাড়াও ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন আদমজী ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা। এ সময় দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আদমজী ইপিজেডের অনন্ত ওয়াশিং লিমিটেডের ৬ জন নারী শ্রমিক ও সিম্বা ফ্যাশন লিমিটেডের ১ পুরুষ শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ঘটনাস্থল থেকে অসুস্থ শ্রমিকদের প্রথমে বেপজা মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানে ৪ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাদের বাড়ি ফেরত পাঠানো হয়। অবশিষ্ট ৩ জনকে চিকিৎসার জন্য শহরের ৩০০ শয্যার খানপুর হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ ওয়েদার অবজার্ভার টিম এর তথ্যমতে ভূমিকম্পের কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভোলাব ইউনিয়নে ছিল। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৫.৭ ছিল । শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৯ মিনিটে এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এ সময় ভবনগুলো তীব্রভাবে দুলতে থাকে। আতঙ্কিত মানুষজন দ্রুত ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন।
স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে, ভূমিকম্পে রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের ইসলামবাগ এলাকায় ধসে পড়া একটি সীমানা দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছে শিশু ফাতেমা। গুরুতর আহত হয়েছেন শিশুটির মা কুলসুম বেগম এবং প্রতিবেশী জেসমিন বেগম। তারা একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আড়াইহাজার উপজেলায় হাইজাদী ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন গ্রামে একাধিক বাড়ির দেয়াল ভেঙে গেছে। এতে অন্তত ৬ জন আহত হয়েছেন। এ সময় আহতদের একজন মোহন বলে জানা গেছে। বাকিদের নাম পাওয়া যায়নি।
এ সময় সবচেয়ে বেশী ক্ষতগ্রস্থ হয় আড়াইহাজারের হাইজাদী ইউনিয়নের কয়েকটি বাড়ি। সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ভূমিকম্পে স্কুল মাদরাসাসহ একাধিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। সিদ্দিকিয়া মাদরাসার ভবনের দেয়াল ধসে যায়।
সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল হিরাঝিল বাংলা শাখা ভবনে ফাটল দেখা দেয়। ভূমিকম্পের সময় ওই ভবনে ভেনাস এডুকেশন সোসাইটির আয়োজনে বৃত্তি পরীক্ষা ছিল, যেখানে বিভিন্ন স্কুলের ৪ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এ সময় দ্রুত শিক্ষার্থীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়।
এছাড়াও হাউজিং এলাকা, হীরাঝিল আবাসিক এলাকা, আল ইসলাম নগর, রনি সিটির ৪ নম্বর গলি ও ৫ নম্বর রোড এসব জায়গায় বহু ভবনের দেওয়াল, কলাম, সিঁড়ি ও সাইড দেয়ালে ফাটল দেখা গেছে। কিছু ভবনের সাইড দেওয়াল ভেঙে পাশের টিনশেড ঘরের ওপর পড়েছে।
ফতুল্লার কাশিপুরের ৭৫ বছরের বয়স্ক বাসিন্দা অনুতপ্ত সাহা জানান, আমার জীবনে এত ভয়াবহ কম্পন কখনো অনুভব করিনি। এটি ছিল সত্যিই আতঙ্কজনক। ভূমিকম্প শুরু হতেই নারায়ণগঞ্জ শহরসহ জেলার বিভিন্ন বহুতল ভবন থেকে আতঙ্কিত নারী-পুরুষ ও শিশুরা দ্রুত নিচে নেমে আসে।
ফতুল্লার শিল্পাঞ্চল বিসিক এলাকায় কয়েকটি রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু থাকায় শ্রমিকরাও নিরাপদ স্থানে বেরিয়ে আসেন।
হীরাঝিল আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রাসেল আহমেদ বলেন, হঠাৎ করে পুরো বিল্ডিংটা দুলে উঠল। প্রথমে বুঝতেই পারছিলাম না কী হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দেওয়ালে ফাটল দেখা যায়। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে নিচে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি।
মুক্তিনগর এলাকার বাসিন্দা সেলিনা আক্তার বলেন, টায়ার গলির একটি বহুতল ভবনের দেওয়ালে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে এবং কয়েকটি রুমের টাইলস ভেঙে পড়েছে। রান্নাঘরের শোকেস থেকে জিনিসপত্র পড়ছিল। ভয়ে আমরা সবাই বাইরে বের হয়ে যাই।
আল ইসলাম নগরের বাসিন্দা আব্দুল গফুর বলেন, ভবনটা এমনভাবে দুলছিল, মনে হচ্ছিল পাশের দিকে হেলে পড়ছে। ভূমিকম্প থামার পর দেখি কলামে ফাটল। এখন পরিবার নিয়ে কোথায় থাকব বুঝতে পারছি না।
এদিকে ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও প্রকৌশলীরা ভবনগুলোর ঝুঁকির মাত্রা যাচাই করতে জরুরি পরিদর্শন শুরু করেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে প্রবেশ না করতে বাসিন্দাদের সতর্ক করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আশপাশের আরও ভবনেও ফাটল দেখা দিয়েছে এসব ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞ দলের দ্রুত পরিদর্শন জরুরি।
নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা খানপুর হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক আবুল বাশার জানান, আদমজি ইপিজেডের ৩ জন শ্রমিকসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার ৫ জন আতঙ্কগ্রস্থ রোগী খানপুর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন জানান, এটা প্রাকৃতিক দূর্যোগ। আল্লাহর রহমতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি নারায়ণগঞ্জ জেলায় হয়নি।
যারা বহুতল ভবনের বাসিন্দা তারা ভূমিকম্পের সময় নিচে নামবেন না। ঘরের ভেতর ভবনের কলাম এর পাশে দাড়াবেন অথবা সিড়িকোঠার নীচে থাকবেন। আর নিচতলার বাসিন্দারা বাইরে চলে যাবেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. রায়হান কবির বলেন, ইতিমধ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ভবনের ফাটল নিয়ে একাধিক টিম মাঠে কাজ শুরু করেছে। তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
কোনো ভবন বসবাসের অযোগ্য হলে ওই ভবন থেকে বাসিন্দারের সরিয়ে নেয়া হবে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।


































