নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শনিবার,

১৮ মে ২০২৪

বন্দরে ভোটের মাঠে জটিল অংকে তিন প্রার্থী 

নারায়ণগঞ্জ টাইমস:

প্রকাশিত:২১:১৫, ৪ মে ২০২৪

বন্দরে ভোটের মাঠে জটিল অংকে তিন প্রার্থী 

আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ প্রথম ধাপের নির্বাচন। ওইদিন নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার ভোট গ্রহণ। এই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন তিন হেভিওয়েট প্রার্থী। তারা হলেন, বন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা এম এ রশিদ, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির বিদ্রোহী গ্রুপের যুগ্ম আহবায়ক  দুই বারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল ও  মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা জাতীয় পার্টির সহ সভাপতি  মাকসুদ হোসেন। এই তিন প্রার্থীর পৃথক রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও তিন প্রার্থীই ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘ বহু বছর ধরে তারা ওসমান পরিবারের ইশারা ইঙ্গিতেই রাজনীতি করে আসছেন। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের সাথে এই তিনজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গত কয়েক বছর ধরে ওপেন সিক্রেট। কিন্তু নির্বাচনে তিনজনই শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থেকে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন সেলিম ওসমান। যদিও নানাভাবে তিনি চেষ্টা তদবির করেছেন সমঝোতার ভিত্তিতে একজন প্রার্থী দিতে। এবং সেই প্রার্থীকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করানোর। সকল হুমকি ধামকি ও মামলা উপেক্ষা করে দুই প্রার্থী (মুকুল-মাকসুদ) তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় ওসমান পরিবারের সমর্থিত প্রার্থীর ঘুম হারাম। তিনি রীতিমত চিন্তিত। রাজাকার পুত্রের দুই হাতে টাকা বিতরণ তাকে এই চিন্তায় ফেলেছে। অন্যদিকে আরেক প্রার্থী নিরবে বিএনপি এবং এন্টি ওসমান পরিবারের সমর্থন নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। যদিও তিনি বিএনপি থেকে বহিস্কৃত।

দলীয় তথ্যমতে, এমএ রশিদ একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সেলিম ওসমানের পিতা একেএম সামসুজ্জোহার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে শামীম ওসমান বলয়ের রাজনীতি করে আসছেন তিনি। সেলিম ওসমান সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন এম এ রশিদের পক্ষে। গত ২৮ মার্চ ধামগড়ে আয়োজিত এক সভায় সেলিম ওসমান প্রকাশ্যে সমর্থন দেন রশিদকে। সেখানে তার দলের নেতা মাকসুদ ও অনুসারী মুকুলের উদ্দেশ্যে বলেন, 'দুইজন আমার অমতে নির্বাচন করার চিন্তা ভাবনা করছেন। একজন নিজেই বলেন রাজাকার সন্তান। আমি বলেছি, মানুষের জন্য কাজ করো, বাব দাদার পাপ ভুলে যাও। পাপে বাপেরেও ছাড়ে না। মাকসুদ সাহেব, আপনি আল্লাহর কাছে মাফ চান। নিজ দায়িত্বে ফিরে আসুন। আপনি যদি ভালোয় ভালোয় কথা শুনেন তো শুনবেন, নাহলে মুগুর কিভাবে বানাতে হয় সেটা আমরা জানি। মুগুরের মাধ্যমেই আপনাকে ক্ষতিগ্রস্থ করা হবে। আরেকজন আমার অত্যন্ত প্রিয়। আমি তাকে বলেছি, আপনাকে মানুষ ভালোবাসে সন্দেহ নাই। আপনি মুরুব্বি হিসেবে থাকেন। আপনাকে বিভিন্ন স্কুলের সভাপতি বানিয়ে দিয়েছি। আপনি মানসম্মান নিয়ে বাকি জীবনটা কাটান। আপনি এই পথ থেকে সরে দাঁড়ান। মোট কথা মাকসুদ ও মুকুলের প্রতি কিছুটা নাখোশ সেলিম ওসমান। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে তার কাছ থেকে সমর্থন  অর্জন না করা এবং অনুমতি না নেয়াকে কেন্দ্র করে। ৩০ এপ্রিল সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান এক সাথে বক্তব্য রেখে চাপ বাড়ান মাকসুদ ও মুকুলের উপর। সেখানে সেলিম ওসমান মুকুলের উদ্দেশ্যে বলেন, 'এখানে অনেকের পোস্টার উড়ছে। যাদের পোস্টার উড়ছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ উপস্থিত হন নাই। অথচ কয়দিন আগেও তারা সেলিম ভাই সেলিম ভাই বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলতেন। আজ যারা উপস্থিত আছেন তারা স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি। কোন বিএনপি নেতা বঙ্গবন্ধুর অপমান করে বন্দরে নির্বাচন করতে পারেন না। সে আবার এই এলাকা থেকে নির্বাচন করার কলিজাটা কোথায় পায়? কোথায় আমার আওয়ামী লীগের কর্মীরা? আপনারা হাতে কি চুড়ি পড়েছেন?' একই বক্তব্যে মাকসুদের উদ্দেশ্যে সেলিম ওসমান বলেন, “একজন রাজাকার পুত্র, জমি দখলকারীর পোস্টার কীভাবে এলাকায় থাকে? কিভাবে শত শত গাড়ি বের করে? মানুষ অবজেকশন দিলে উনি বলেন, 'সরি'। এতেই নির্বাচন কমিশন ওনাকে ছেড়ে দেন। প্রশাসনের লোকজনকে বলবো ঘুমিয়ে গেলে হবে না, এগুলা দেখতে হবে।' অন্যদিকে শামীম ওসমান তার বক্তব্যে বলেন, 'এইখানে এসে শুনলাম, কেউ কেউ এমন এমন বক্তব্য দিচ্ছেন আর এমন এমন কথা বলছেন, ওই কথাগুলো যদি আমলে নেই তাহলে আগামীকাল থেকে কেউ মাঠে নামতে পারবেন না। আমি সেলিম ওসমান না, আমরা জানি কী করতে হবে। কথাবার্তা সীমানার মধ্যে রাখেন। আমরা ক্ষমতা দেখালে কেউ নির্বাচন করতে পারতেন না। কেউ কেউ কিছু কথা বলেছেন। ওই কথাগুলো শোনার পরে যদি আজকে আমার ভাইয়ার মৃত্যুবার্ষিকী না হতো তাহলে আমি একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে যাইতাম। কিন্তু সেই কাজটি আমি করবো না, কারণ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।  মুখের বুলি আর বন্দকের গুলি একবার বের হয়ে গেলে ফেরত যায় না, কথা বলার সময় এইটা মাথায় রেখে কথা বলবেন। আর এইটাই শেষ না, সামনে আরও সময় আছে। মিলেমিশে ছিলেন মিলেমিশে থাকেন।


সবশেষ ১ মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে তোলা একটি ছবি। যেখানে দেখা যায় এমএ রশিদকে সাথে নিয়ে এমপি শামীম ওসমান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চন্দন শীল, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই, সাধারণ সম্পাদক ভিপি বাদল উপস্থিত হয়েছেন মন্ত্রীর সাথে। কথাবার্তা শেষে হাসি-মুখে ছবি তোলেন। পরে সেই ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে ভোটের মাঠে এই ছবি আহামরি কোন প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন সাধারণ ভোটাররা। এই ছবি হয়তো আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করবে দোয়াত কলম প্রতীকের পক্ষে।


ওদিকে স্থানীয়রা বলছেন, রাজাকার পুত্র মাকসুদ যদিও দুই হতে টাকা ছিটিয়ে মাঠ গরম করে রেখেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক বিয়ে, এক স্ত্রী-সন্তানকে অস্বীকার করার অভিযোগ মানুষের মুখে মুখে। এ নিয়ে আদালতে ও থানায় নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে মাকসুদের বিরুদ্ধে। তার পারিবারিক ব্যাক গ্রাউন্ডও বিতর্কিত। ফলে মাকসুদের টাকা পিছনে এক শ্রেণির মানুষের দৌড়ঝাপ দেখা গেলেও সাধারণ ভোটাররা কষছেন অন্য হিসেব। তাদের মতে, যিনি নিজেই পারিবারিকভাবে বিতর্কিত। তিনি কিভাবে অন্য পরিবারকে সুরক্ষা দিবেন। এছাড়া তার একটি অপরাধী বাহিনী সক্রীয় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের ভোটও তার বাক্সে পড়ার সুযোগ কম।

 

অন্যদিকে রাজনীতিতে বহুরূপী হিসেবে পরিচিত আতাউর রহমান মুকুল। বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও দলের বাইরে গিয়ে ওসমান পরিবারের রাজনীতি করছেন কয়েক বছর ধরে। কখনো জাতীয় পাটির মঞ্চে, কখনো আওয়ামীলীগের সাথে তাকে দেখা গেছে। বিএনপির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরী হলেও বিএনপির পরীক্ষিত কর্মী হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। ফলে বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পাটির বি-টিম হিসেবে পরিচিত মকুল। নির্বাচনী মাঠে তার টার্গেট বিএনপির ভোট। কিন্তু যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সেখানে বিএনপির ভোট কতটা টানতে পারবেন তা দেখার বিষয়। যদিও শুক্রবার (৩ মে) নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি হুশিয়ারী দিয়েছেন, বন্দর উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কোন নেতাকর্মী উপজেলা নির্বাচনের প্রচারণায় অংশ নেবে না। যদি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ উপজেলা নির্বাচনের প্রচারণায় অংশ নেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।


মহানগর বিএনপির সভাপতি এডভোকেট সাখাওয়াত খান বলেছেন, বন্দর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত আতাউর রহমান মুকুল। দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে সরকার দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করায় তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ইতিপূর্বে আতাউর রহমান মুকুল বিএনপতে থেকে বিএনপির গঠনতন্ত্র বিরোধী এবং দলীয় সিদ্ধান্ত বিরোধী কর্মকাণ্ডে এমনভাবে লিপ্ত ছিলেন যাতে করে তার ৫০ বার বহিষ্কার হওয়া উচিত ছিল বলে জানান তিনি।


তবে এন্টি ওসমান সেন্টিমেন্টকেও কাজে লাগানোর মিশনে আছেন মুকুল। এছাড়া গোপনে ধর্না দিচ্ছেন শহরের দক্ষিন বলয়ের কাছে। বন্দরে তাদের সমর্থিত লোকজনের সাপোর্টটা যেন তার দিকে থাকে। কারণ বিগত সিটি নির্বাচনগুলোতে পরোক্ষভাবে মকুলের সমর্থন ছিলো বিএনপির প্রতিপক্ষ প্রার্থীর পক্ষে। যার কারণে সেই সমর্থনের বিনিময় নেয়ার মিশনে আছেন তিনি।


তবে বন্দরের বিভিন্ন পর্যায়ের সচেতন নাগরিকরা বলেছেন, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে ফলাফল পাল্টে দেয়ার সুযোগ বন্দরে না হওয়ার সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যে। সুষ্ঠ শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ ভোট হলে লড়াইটা শেষ পর্যন্ত ত্রি-মুখীই হবে। কারণ নির্বাচনের মাঠে তিন প্রার্থীর ভোটের নানা অংক কষছেন ভোটাররা। সবমিলিয়ে ৮ মে শেষ হাসি কে হাসবেন তা দেখার অপেক্ষায় বন্দরবাসী।


উল্লেখ্য, মদনপুর, ধামগড়,  মুছাপুর, বন্দর ও কলাগাছিয়া ৫ টি ইউনিয়ন নিয়ে বন্দর উপজেলা পরিষদ গঠিত। মোট ৫৪টি ভোট কেন্দ্রে।  মোট ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৬৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬৭ হাজার ৫০০, নারী ভোটার ৬৪ হাজার ৬২।