
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজধানী লগোয়া শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী মাঠ সরগরম হয়ে উঠেছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারনায়। নিজেকে দলের কাছে যোগ্য প্রার্থী এবং ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে গণসংযোগ, কর্মীসভাসহ নানা কার্যক্রম চালাচ্ছেন সম্ভাব্য এই প্রার্থীরা।
নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় তাদের ছবি সম্বলিত পোস্টার, ফেস্টুন-ব্যানার শোভা পাচ্ছে। বিতরণ করা হচ্ছে লিফলেট। চলছে পথসভা ও উঠান বৈঠকও। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটারদের দ্বারে যাচ্ছেন প্রার্থী ও প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা।
নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন হলো শহর ও বন্দর নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন। শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দারা এই আসনের ভোটার। আসন্ন নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর একক প্রার্থী ঘোষিত হলেও বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনোনয়ন যুদ্ধে সরব রয়েছেন। তবে গণসংহতি আন্দোলও তাদের একক প্রার্থী ঘোষণা করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপি থেকে প্রার্থিতার জন্য সরব রয়েছেন ৬ জন। তারা হলেন-সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবুল কালাম, মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, মডেল গ্রুপের চেয়ারম্যান শিল্পপতি মাসুদুজ্জামান, প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু জাফর আহমেদ বাবুল, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু ও লন্ডনের নর্থামব্রিয়া ইউনিভার্সিটির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আলিয়ার হেসেন।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চুড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির কর্মপরিষদ সদস্য ও সাবেক নারায়ণগঞ্জ মহানগরের আমীর মাওলানা মাঈনুদ্দিন আহমেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ, খেলাফত মজলিস নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ডা. আল-আমিন রাকিব, ইসলামী ঐক্যজোটের মহানগরের সভাপতি মুফতি জাকির হোসেন কাশেমী।
গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম সুজন। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জাতীয়পাটির নেতা মাকসুদ হোসেন। এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি থেকে আহমেদুর রহমান তনুর নাম শোনা যাচ্ছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই এ আসনে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি প্রায় সমানভাবেই নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তবে বেশির ভাগ সময়ে এই আসনটি নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সদস্যরা সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের ২০১৪ সাল পর্যন্ত এখানে সংসদ সদস্য ছিলেন নাসিম ওসমান।
তিনি ওই বছরের ৩০ এপ্রিল মারা যান। এবং একই বছর উপনির্বাচনে এ আসনের সংসদ সদস্য হন সেলিম ওসমান। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওসমান পরিবারের সদস্যরা পলাতক রয়েছেন। ফলে এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রায় তিনবার সংসদ সদস্য ছিলেন অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি বিএনপির দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী।
তিনি বলেন, আমি আগেও নির্বাচন করেছি আগামীতেও করবো ইনশাল্লাহ। নির্বাচনের জন্য সম্পূর্নভাবে প্রস্তুত রয়েছি। নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো। আশা করছি দল আমাকে পূর্বের মতো এবারও মূল্যায়ন করবে।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৬ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বতা করেছিলেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতিতে আছি। আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে জেল খেটেছি, ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে। তারপরও দল ও জনগণের পাশে ছিলাম জীবনবাজি রেখে। সামনে নির্বাচন, সাধারণ মানুষের আগ্রহ আমি যেন নির্বাচন করি। সেই হিসেবে আমি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় আমি আমার নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমি আশা করি দল আমাকে প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করবে।
শিল্পপতি মাসুদুজ্জামান বলেন, ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর এই আসনের জনগণ এবং তারুণ্যের আইডিয়ার সমন্বয়ে আমরা একটি নতুন নারায়ণগঞ্জের স্বপ্ন দেখছি। এই কারণেই নির্বাচন করার জন্য মাঠে নামা। ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ডাটা সংগ্রহ করতেছি।
আসলে সমস্যাগুলো কোথায়? সেগুলো চিহ্নিত করতেছি। যদি নির্বাচন করি বা নির্বাচিত হই সেই সকল সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করবো। দলের নেতকার্মীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। প্রতিদিনই তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তবে দল যাকে মনোনয়ন দিবে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে তার পেছনেই থাকবো।
প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু জাফর আহমেদ বাবুল বলেন, আমি বিএনপি আর্দশের মানুষ। ৫ আগস্টের পর এলাকার আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃংলাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছি। স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষের ইচ্ছায় নির্বাচন করার জন্য মাঠে নেমেছি।
আমি নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সমস্যা ও নগরবাসীর কল্যানে দীর্ঘদিন নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যানজট নিয়ন্ত্রন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত আমি ও আমার টিম কাজ করে যাচ্ছে।
এছাড়াও আরো সে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো নিয়ে নানা পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জবাসীর কল্যানে আমার সকল কাজ চলমান থাকবে। আমি বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবো। আশা করি দল আমাকে মূল্যায়ন করবে।
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেন, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে দল আমাকে যেভাবে দায়িত্ব দিয়েছে তা সঠিকভাবে পালন করেছি। রাজপথ থেকে গ্রেপ্তার হয়েছি। জেল খেটেছি। একজন নির্যাতিত হিসেবে আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এলাকায় কাজ করছি।
অধ্যাপক আলিয়ার হোসেন বলেন, টেকসই, স্মার্ট ও আধুনিক নারায়ণগঞ্জ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে নির্বাচন করার জন্য মাঠে নেমেছি। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দলের জন্য কাজ করেছি এবং করছি। দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো। তবে দল যাকে দিবে তার পক্ষে কাজ করবো। এবং যিনি এখানে নির্বাচিত হবেন আমার নির্বাচনী ইশতেহারগুলো তাকে দিয়ে বাস্তবায়ন করানো চেষ্টা করবো।
জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী মাওলানা মাঈনুদ্দিন আহমেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে আমরা নির্বাচনের কথা বলতে শুরু করেছি। মানুষ অনেক দিন ধরে ভোট না দিতে না দিতে ভোটের অভ্যাস নস্ট হয়ে গেছে। মানুষ যাতে ভোট দিতে আসেন তাদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছি। আর মানুষের কাছে যখন যাচ্ছি তখন মনে হচ্ছে মানুষও ভোট দিতে আগ্রহী।
ইসলামী আন্দোলনের মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, আগামী নির্বাচনের জন্য দল থেকে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে। তাই আমি প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। প্রায় প্রতিদিনই আমি কোন না কোন এলাকায় গণসংযোগ করছি। এবং সাধারণ মানুষের সাড়াও পাচ্ছি।
স্বতন্ত্র প্রার্থী বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন বলেন তিনবার মুছাপুর ইউনিয়নের চেয়াম্যান ছিলাম। সবশেষ উপজেলা নির্বাচনে ওসমান পরিবারের চরম বিরোধীতার মুখে বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। ৫ আগস্টের পর নিজস্ব অর্থায়নে রাস্তা-ঘাট সংস্কারসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করছি।
তিনি বলেন, জনগণের ইচ্ছায় আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবার জন্য কাজ করছি। প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী কার্যক্রম চালাচ্ছি। বিগত দিনের মতো সংসদ নির্বাচনেরও ভোটাররা আমার পাশে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম সুজন বলেন, বিগত সময়ে যারা এখানে এমপি নির্বাচিত হয়েছিল তারা এলাকার জনগণের জন্য তেমন কিছু করেনি। তাদের দেখেছি সরকারের লুটপাটের সহযোগি হতে। ফলে এই নারায়ণগঞ্জ শহরটি অপরিকল্পিত এবং ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
আমি যদি আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হই তাহলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের গুণগত পরিবর্তন এবং নারায়ণগঞ্জের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এই নারায়ণগঞ্জকে একটি পরিকল্পিত এবং বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলবো।