নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শুক্রবার,

১৯ এপ্রিল ২০২৪

পুকুর থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে দেখা করে আবার পুকুরে ডুব দিয়েছে বাবু!

নারায়ণগঞ্জ টাইমস:

প্রকাশিত:০৩:৫৩, ৯ মে ২০২২

পুকুর থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে দেখা করে আবার পুকুরে ডুব দিয়েছে বাবু!

নারায়ণগঞ্জের বন্দরে পুলিশের ধাওয়ায় পানিতে ডুবে যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের প্রতিবেদন ও নিহতের মায়ের জিডি নিয়ে ধ্রমজালের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ বলছে, ৩০ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায় নিলয় আহমেদ ওরফে বাবু নামে ওই যুবক প্রতিবেশীদের ধাওয়ায় ডোবায় পড়ে ডুবে যায়। কিন্তু নিহতের মা জিডিতে উল্লেখ করেছেন তার ছেলে ১ মে রাত সাড়ে ১০টায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিখোঁজ হয়। 

 


এদিকে ওই যুবকের লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ এলাকাবাসীর বিক্ষোভের মুখে পড়েছিল। এলাকাবাসীর অভিযোগ ছিল, পুলিশের ধাওয়া খেয়ে ভয়ে ডোবায় ঝাপ দেয় ওই যুবক। ৪দিন পর তার লাশ ভেসে উঠে। এসময় নিহতের মা লিলি বেগম, বোন ও খালাতো ভাই ইমন এবং প্রতিবেশীরা প্রকাশ্যে চিৎকার করে বলতে থাকেন পুলিশ বাবুকে মেরে ফেলেছে। পুলিশের ভয়ে সে ডোবায় ঝাপিয়ে পড়ে ডুবে যায়। আমরা পুলিশ কর্মকর্তা এসআই রওশন ফেরদৌসের বিচার চাই। তিনিই এ হত্যার জন্য দায়ী। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রæত অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা রওশন ফেরদৌসেকে ক্লোজড (প্রত্যাহার) করা হয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো রহস্যজনকভাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে নিহতের মা লিলি বেগমকে দিয়ে পুলিশ বন্দর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করায়। ওই মামলায় ১ নাম্বার আসামী করা হয়, নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর ও বন্দর) আসনের সাবেক এমপির ছেলে ও মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নাসিকের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কাউছার আশাকে। এই ঘটনায় চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে। অন্যদিকে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভুমিকা নিয়ে।


জিডিতে যা উল্লেখ ছিল
নিহত নিলয় আহমেদ ওরফে বাবুর মা লিলি বেগম ২ মে বন্দর থানায় একটি জিডি করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করে, ১ মে অনুমান রাত ১০ টায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার কথা বলে তার ছেলে বাবু বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর বাড়িতে ফিরে আসেনি। সকল স্থানে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে থানায় জিডি করতে আসলাম। বিষয়টি নিয়ে আত্মীয়-স্বজন আলোচনা করতে গিয়ে জিডি করতে বিলম্ব হলো। জিডি নং-৭৯। তবে জিডিতে তিনি তার ছেলে নিখোঁজ হওয়ার জন্য কাউকে দায়ি করেননি।      

 


মামলায় যা উল্লেখ করা হয়
নিহতের মা লিলি বেগম মামলায় উল্লেখ করেন, হাসিনা বেগম নিলয় বাবুর বিরুদ্ধে থানায় একটি অভিযোগ করেন। অভিযোগের তদন্তে এস আই রওশন ফেরদৌস ঘটনাস্থলে যায়। পরে বিষয়টি মিমাংসার জন্য ২৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কাউছার আশা দায়িত্ব নেয়। সে বাবুকে আসতে বললেও বাবু তার কার্যালয়ে আসেনি। পরে কাউন্সিলর আশা লোকজন পাঠিয়ে বাবুকে ধরে আনার নির্দেশ দেয়। ৩০ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায় আশার লোকজন বাবুকে ধরে আনতে গেলে তাদের ভয়ে বাবু পাশের পুকুরে ঝাপ দেয়। পরে আশার লোকজন পুকুরে ইট পাটকেল মারে। ইটপাটকেলের আঘাতে জখম হয়ে বাবু পুকুরে পড়ে থাকে। পরে ঘটনার চারদিন পর বাবুর লাশ ওই পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। মামলায় তিনি কাউন্সিলর আশাকে প্রধান করে ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় পুলিশ হাসিনা বেগমসহ ২জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে।


এদিকে ওই ঘটনায় ক্লোজ হওয়া পুলিশের এসআই রওশন ফেরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার ব্যাপারে কোন কথা বলতে রাজি হননি।


ওদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রেজাউল করিম ৫ মে গ্রেপ্তারকৃত হাসিনা বেগমসহ দুইজনকে আদালতে পাঠানো সময় প্রতিবদনে উল্লেখ করেছেন, ৩০ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায় মামলার বাদীনি লিলি বেগমের ছেলে নিলয় বাবুকে ধরে আনার জন্য তার বাড়িতে যায়। তখন নিলয় বাবু তাদের দেখে দৌড়ে পালানোর সময় ভয়ে বাড়ির পাশে ময়লা-আবর্জনা ঘাসযুক্ত পুকুরে পড়ে যায়। এসময় হাসিনা বেগমসহ অন্যান্য আসামীরা নিলয় বাবুকে উদ্দেশ্য করে ইট-পাটকেল মারলে সে মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে পানির মধ্যে ডুবে যায়। তখন হাসিনা বেগম সহ অন্য আসামীরা প্রচার চালায় যে বাবু পুকুর থেকে উঠে পালিয়েছে। কিন্তু ৪ মে নিলয়র বাবুর ভাসমান লাশ ওই পুকুরে পাওয়া যায়।


এখন প্রশ্ন হলো-৩০ এপ্রিল নিলয় বাবু পানিতে ডুবে গেলে ১ মে রাত ১০ টায় কিভাবে সে তার মায়ের কাছ থেকে বন্দুদের সঙ্গে দেখা করতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল? তাহলে বুঝা যাচ্ছে বাবু পুকুর থেকে উঠে আবার তার মায়ের সঙ্গে দেখা করে পুকুরে নেমে ডুব দিয়েছে। এবং পরে লাশ ভেসে উঠে।


নিহতের স্বজনদের বক্তব্য পরে উল্টে যায় 
লাশ উদ্ধারের সময় নিহতের খালাতো ভাই ইমন আহাম্মেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আমার ভাইকে পুলিশ কর্মকর্তা ফেরদৌস মাইরালাইছে শুধু শুধু হয়রানি কইরা। এক মহিলার কাছ থেকে টাকা খাইয়া পানিতে ফালাইয়া ঢিল্লা দিয়া মরছে। আমি এর বিচার চাই।

 


নিহতের মা লিলি বেগম বলেছেন, আমার ছেলেকে না পেয়ে থানায় জিডি করেছি। ওই মহিলা (হাসিনা বেগম) মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে দারোগা ফেরদৌসকে দিয়ে আমার ছেলেকে লাশ বানিয়েছে। আমি এর বিচার চাই। 

 


তিনি আরও বলেন, দারোগায় কয়, বাবু মইরা গেলেগা সবাই বাঁচলেন। আর যদি বাবু বাইচ্চা যায়গা বাবু তিন মাস পর আসবো তার মার বুকে। লিলি বেগম ও ইমনের এমন বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু লাশ উদ্ধারের কয়েকঘন্টা পর তার বক্তব্য পাল্টে যায়। মামলায় পুলিশের ধাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ না করা প্রসঙ্গে লিলি বেগম বলেন, ধাওয়া পুলিশ দিয়েছিলো বলে শুনেছিলাম। পরে শুনলাম কাউন্সিলরের লোকজন ধাওয়া দিয়া পানিতে নামাইছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিছি।

 


ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঘটনার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইজিবাইকে একদল পুলিশ আসে। তাদের মধ্যে সাদা পোশাকে ছিলেন এসআই ফেরদৌস। তার কোমরে পিস্তল ও হাতকড়া ছিল। বাকি দুজন পুলিশ সদস্য পোশাক পরা ছিলেন এবং হাতে ছিল রাইফেল। তাদের সঙ্গে হাসিনা বেগম নামে ওই নারীও ছিলেন। পুলিশ এসেই জনৈক সাইদুলের টিন সেডের ভাড়া বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন। সেখানেই অবস্থান করছিল নিলয়। পুলিশের ধাওয়ায় পাশের পরিত্যক্ত ডোবায় ঝাঁপ দেয় নিলয়। তাকে উপরে তোলার জন্য ডোবায় ঢিল ছোঁড়েন এসআই রওশন ফেরদৌস ও স্থানীয় কয়েকজন। তবে নিলয়কে আর উপরে উঠতে দেখা যায়নি। ততক্ষণে এলাকায় মানুষজনের ভীড় জমে যায়। তাদের ধমক দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে দেন এসআই ফেরদৌস।


বাগবাড়ি পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আক্তার হোসেন বলেন, পুলিশের ধাওয়াতেই ডোবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবু। পরে এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে জড়ো হয়েছিল। পুলিশকে নিয়ে এসেছিল হাসিনা। তার কাছ থেকে বাবু টাকা খেয়েছিল বলে শুনেছি, সেটা নিয়ে থানায় অভিযোগ দিছিল সে।


নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৩নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাউছার আশা বলেন, নিলয় বাবুর বিরুদ্ধে থানায় আগেও বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা পুলিশের পোশাক পড়ে ডাকাতির ঘটনা বলে শুনেছি। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এই মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর দুলাল প্রধান। নিহত নিলয় তার আত্মীয়।’


এই বিষয়ে দুলাল প্রধানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি। 


ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেন, ‘যে মারা গেছে তার বিরুদ্ধে পূর্বে একাধিক মামলা ছিল। সে জেলও খেটেছে। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো ওয়ারেন্ট ছিল না। আমরা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। মামলায় কাউন্সিলর আশাকে আসামী করা প্রসঙ্গে তিনি বলে, এটা বাদির বিষয়। তিনি যাকে দোষি মনে করেছেন তাকে আসামী করেছেন।


বন্দর থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, বাবু নিহতের ঘটনায় নিহতের মা বাদি হয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন। ইতিমধ্যে এক নারীসহ ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসআই রওশন ফেরদৌসকে ওই ঘটনায় তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে ক্লোজ করা হয়েছে। সবকিছু তদন্তাধীন রয়েছে। বাবু নিহত হওয়ার ঘটনায় তার মায়ের করা জিডি ও মামলায় ঘটনার তারিখ এবং ঘটনা প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্যে গড়মিল প্রসঙ্গে ওসি বলেন, সবকিছু তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তে সবকিছু বেরিয়ে আসবে। 

 


 

সম্পর্কিত বিষয়: