শুক্রবার বিকেলের সূর্যটা একটু নরম হয়ে এলে লিসবনের মার্তিম মনিজ যেন পাল্টে যায়। ট্রামের ঘণ্টা বাজতে বাজতেই গলির ভেতর থেকে ভেসে আসে ভাজা সিঙ্গারার গন্ধ। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কারও ডাক—“ভাই, এক কাপ চা দিবেন।” আশেপাশে তাকালে মনে হয় না, এটা ইউরোপের কোনো শহর। বরং ঢাকার কোনো মোড়, কিংবা নারায়ণগঞ্জের কোনো বাজার। বিদেশের মাটিতেও এখানে টিকে আছে এক টুকরো বাংলাদেশ—বাংলাদেশিদের কোলাহল, খাবার, ভাষা আর হাসির আড্ডায়।
মার্তিম মনিজে বাংলাদেশিদের পদচারণা শুরু নব্বইয়ের দশকে। কাজের খোঁজে, ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্নে অনেকেই পাড়ি জমিয়েছিলো পর্তুগালের লিসবনে। প্রথমে সংখ্যায় কম হলেও ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ছোট ছোট দোকান, মুদি ব্যবসা, মানি এক্সচেঞ্জ আর রেস্টুরেন্ট। বছরের পর বছর পরিশ্রম আর পর্তুগিজ সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার লড়াই বাংলাদেশিদের স্থায়ী করে তোলে এই এলাকায়। এখন মার্তিম মনিজকে বলা হয় ‘বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রাণকেন্দ্র’।
প্রবাস জীবনের গল্প সবসময় সহজ নয়। প্রথমদিকে ভাষার বাধা, বৈধ কাগজপত্রের অভাব, কাজের কষ্ট—সবই ছিল প্রতিদিনের সঙ্গী। কেউ কেউ নির্মাণশ্রমিক হিসেবে দিন শুরু করেছে, কেউ আবার রেস্টুরেন্টে ওয়েটার। সীমাহীন পরিশ্রম, অনিশ্চয়তা আর টিকে থাকার লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে আজকের বাংলাদেশি সমাজ। এখন অনেকেই ছোট দোকান থেকে শুরু করে সফল ব্যবসায়ী হয়েছেন, কেউ আবার নিজের রেস্টুরেন্টকে শহরের মানচিত্রে পরিচিত নাম করে তুলেছেন। কিন্তু সেই পথটা ছিল ভীষণ কঠিন—কষ্ট, ত্যাগ আর অক্লান্ত পরিশ্রমের পথ।
আজ মার্তিম মনিজ মানে শুধু বাজার নয়—এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। বিরিয়ানি থেকে শুরু করে সিঙ্গারা, সমোসা, মিষ্টি—সবই পাওয়া যায় এখানে। বাংলা গানের সুর ভেসে আসে দোকান থেকে, আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোনা যায় আড্ডায় মিশে যাওয়া বাংলা শব্দ। ঈদ, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবসের মতো দিনগুলোতে এলাকায় সৃষ্টি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ—পর্তুগিজরাও কৌতূহল নিয়ে যোগ দেন সেই আনন্দে। প্রবাসে থেকেও এই সংস্কৃতির রঙই মানুষকে মনে করিয়ে দেয়—“আমরা বাংলাদেশি, আমরা গর্বিত।”
বাংলাদেশিদের জন্য মার্তিম মনিজ শুধু বাজার বা ব্যবসার কেন্দ্র নয়—এটা একধরনের সামাজিক আশ্রয়। নতুন আসা প্রবাসীরা এখানে সহজে কমিউনিটির সঙ্গে মিশে যায়, পায় আপনজনের মতো সাহায্য। দূরদেশে থেকেও মার্তিম মনিজ হয়ে উঠেছে পরিচিত, নিরাপদ আর আপন ঠিকানা।
প্রবাস মানে শুধু ভিনদেশে থাকা নয়, প্রবাস মানে দেশকে বুকে বয়ে বেড়ানো। লিসবনের মার্তিম মনিজে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলে মনে হয়—ঢাকার কোনো রাস্তায় হাঁটছি, চারপাশে পরিচিত ভাষা আর আপন গন্ধ। পর্তুগালের মাটিতে এই ছোট্ট বাংলাদেশ যেন প্রমাণ করে—দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও বাংলাদেশ আমাদের ভেতরে বেঁচে থাকে, শ্বাস নেয়, কোলাহলে মিশে যায়।


































