নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

বুধবার,

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বিদেশে রপ্তানী করে প্রতি মাসে আয় অর্ধকোটি টাকা

রূপগঞ্জে কুঁচিয়া শিকার করে স্বাবলম্বী শতাধিক পরিবার

নাজমুল হুদা

প্রকাশিত:২২:২৬, ৩১ জুলাই ২০২৪

রূপগঞ্জে কুঁচিয়া শিকার করে স্বাবলম্বী শতাধিক পরিবার

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কঁচিয়া শিকার করে প্রায় শতাধিক পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। তাদের সংসারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা। এখানকার খাল-বিল,নালা-ডুবা, ধানী জমি ,বদ্ধ ও মুক্ত জলাশয়ে  প্রাকৃতিক ভাবে বংশ বিস্তার এবং বেড়ে ওঠা কুঁচিয়া রপ্তানী হচ্ছে বিদেশে। প্রতি মাসে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা আয় করছেন তারা।

উপজেলার জলাশয়ে  শতাধিক শিকারী চুঙ্গা বা ওকার ফাঁদ পেতে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ কেজী কুঁচিয়া শিকার করছেন উপজেলার তারাব পৌর এলাকার মাসাবতে রয়েছে কুঁচিয়া বিক্রির মিনি আড়ত। প্রতিদিন ঢাকা থেকে পাইকাররা এসেএখানকার কুঁচিয়া শিকারীদের কাছথেকে এগুলো কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

হাত বদল হয়ে আড়তধার, পাইকার সেখান থেকে রপ্তানীকারকদের মাধ্যমে এই কুঁচিয়া চলে যাচ্ছে বিদেশে। কুঁচিয়া শিকার করেই সংসার চলাচ্ছে এখানকার শতাধিক পরিবার।

খোঁজ নিয়ে জানাযায়, খাল-বিল ডুবা-নালা,ধানী জমিসহ  বদ্ধ ও উনমুক্ত জলাশয়ে প্রাকুতিকভাবে বংশ বিস্তার করা কুঁচিয়া দেখতে  অনেকটাই সাপের মতো।স্থান বেধে এর রয়েছে বিভিন্ন নাম কুচে বাইম, কুঁচে মাছ, কুচিয়া, কুইচ্চা নামে পরিচিত। এদের বৈজ্ঞানিক নাম মনোপটেরাস। নিরীহ এ মাছটির ত্বক মসৃণ, পিচ্ছিল ও আঁশবিহীন। দেহ গাঢ় বাদামি রঙের।

এ মাছ ৬০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। তবে এটি একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু মাছ,এর রয়েছে ঔষধি গুণও। এগুলো অগভীর খাল-বিল হাওর-বাঁওড়, পুকুরে কাঁধা মাটির নিচে বাস করে থাকে। অনেক এলাকার মানুষ কুঁচিয়াকে বিশেষ করে বিভিন্ন রোগের প্রকিষেধক হিসাবেও খেয়ে থাকেন। দেশে কুঁচিয়া খাওয়ার তেমন প্রচলন না থাকলেও বিদেশে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে।প্রতিদিন সারা দেশ থেকে বিপুল পরিমান কুঁচিয়া , থাইল্যান্ড, হংকং, চীন ও জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করা হচ্ছে।

কুঁচিয়া শিকারী,পাইকার ও আড়ৎদারদের সাথে কথা বলে যানা গেছে ,একসময় তারা গ্রামে নীজেদের জমিতে কৃষি কাজ করে সংসারের খরচ জোগাড় করতেন। লোকসানের মুখে পড়ে কৃষি কাজ ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে চলে এসেছেন ঢাকার পাশ্ববর্তি এলাকা রূপগঞ্জে।

এখানে কোনকাজে সুবিধা করতে না পেরে নেমে পড়েছেন বিচিত্র পেশা কুঁচিয়া শিকারে। এখানকার বেশিরভাগ শিকারী প্রত্যান্ত অঞ্চল মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ সহ বিভিন্ন জেলা থেকে কাজের সন্ধানে এসে এ পেশায় জড়িয়ে পরেন। প্রায় শতাধিক পরিবার এ মাছ শিকার ও বিক্রি করে পরিবার নিয়ে জিবীকা নির্বাহ করছেন। 

কুঁচিয়া শিকারীরা উপজেলার কর্ণগোপ,বংশিনগড়,নগাঁও, শান্তিনগর ,ভুলতা, ভায়েলা, পাড়াাগাঁও, মিয়াবাড়ি, হাটাব, আমলাব, কালী, বাড়ৈপাড়, পাঁচাইখা, গোলাকান্দাইল ও কায়েতপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিয়ে এ মাছ ধরছেন।

প্রতিদিন বিকালে একেকজন শিকারী ১০০ থেকে ১৫০টি চুঙ্গা বা ওকায় কেঁচো গেঁথে জলাশয়ের পাড়ে খাল-বিল, ডোবা, ধানিজমিসহ অল্প গভীরে কুঁচিয়া মাছ ধরতে ফাঁদ পাতেন। খাবার খেতে চুঙ্গায় ডুকে কুঁচিয়া মাছ গুলো আটকা পরে যায়। এভাবে একজন শিকারী  প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৬ কেজী কুঁচিয়া মাছ ধরতে পারেন।

প্রতি কেজি কুঁচিয়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা ধরে বিক্রি হয়।একজন শিকারী প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন।সে হিসাবে  উপজেলার প্রায় শতাধিক কুঁচিয়া শিকারী মাসে আয় করেন  ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা। আর এ কুঁচিয়া মাছ বিক্রিকে কেন্দ্র করে উপজেলার তারাব পৌরসভার মাসাব এলাকায় গড়েওঠেছে মিনি আড়ত।

প্রতিদিন ঢাকা থেকে পাইকাররা এসে এগুলো কিনে নিয়ে যান। অনেক শিকারীরা একটু বেশি লাভের আশায় রাজধানীর উত্তরা হাউজ বিল্ডিং কোনাবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকার আড়ত গুলোতে নিয়ে বিক্রি করে থাকেন।আর এসব কুঁচিয়া হাতবদল হয়ে রপ্তানীকারকদের মাধ্যমে চলেযায় বিদেশে।   

উপজেলার বংশিনগড় এলাকায় গেলে দেখা হয় স্বপন বিশ্বাসের সঙ্গে। কাঁধে অনেকগুলো চুঙ্গা নিয়ে ছুটে চলছেন তিনি কুঁচিয়া মাছশিকারের জন্য। তিনি জানান, গ্রামে কৃষিকাজ করে তেমন আয় রোজগার হতো না। অভাব অনটনেই দিন কাটত। একদিন এলাকার সনাতন সরকার তাকে বলেন, রূপগঞ্জে তার কুঁচিয়ার আড়ত রয়েছে। এখানে কুঁচিয়া শিকারে ভাল আয় করা যায়। তার পর তার সাথে এখানে চলে আসা।এখন এ মাছ বিক্রি করা টাকা দিয়ে সংসার খরচ শেষে আয়ও করতে পারছি।

কুঁচিয়া শিকারী  শাহাদাৎ হোসেন ও সুবেদ আলী জানান, তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার চন্দ্রা এলাকায় হলেও দীর্ঘ দিন রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে কুঁচিয়া শিকার করে আসছেন। প্রতিদিন  ১০০ থেকে ১৫০ টি চুঙ্গা পেতে ৫ থেকে ৬ কেজী কুঁচিয়া ধরা যায়।এগুলো বিক্রি করে ১৫০০ থেকে ২০০০হাজার টাকা রোজগার করা যায়।

তারা জানান, ঐ এলাকার অনেক লোক এখানে এসে এ পেশাকে বেঁছে নিয়েছে। আয় রোজগার ভাল বিধায় এ ছাড়াও হবিগঞ্জের জাকির হাসেন, রমজান, মাজু, উহাদ আলী, কাশেম, ময়মনসিংহের  দুলাল, বাবুলও  দ্বীন ইসলামসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় শতাধিক লোক এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছে।

আড়ত মালিক সনাতন সরকার বলেন, আমার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায় কর্মসংস্থান না থাকায় কাজের সন্ধানে কয়েক বছর আগে এখানে চলে আসি এবং এ পেশায় জড়িয়ে পরি। ৫০ থেকে ৬০ জন শিকারী আমার আড়তে এ মাছ বিক্রি করে থাকে। এছাড়াও আরও অনেকে ঢাকার বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করে।রূপগঞ্জে প্রায় শতাধিক কুঁচিয়া শিকারী এ পেশার মাধ্যমে সংসার চালাচ্ছেন। 

রাজধানীর পাইকার দিলিপ বিশ্বাস জানান, তাদের ১১জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। তারা রূপগঞ্জসহ ঢাকার আশেপাশের জেলা ও দেশের বিভিন্ন জায়গার আড়ত ধার এবং শিকারীদের কাছ থেকে কুচিয়া সংগ্রহ করে তা ঢাকার উত্তরা এলাকার কয়েকটি রফতানিকারক পতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেন। প্রতিমাসে তারা  ৬০ থেকে ৮০ মেট্রিক টন কুচিয়া রপ্তানী কারকদের কাছে সরবরাহ করেন।

রূপগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ইমরান হোসেন  বলেন, কুঁচিয়ার বিদেশে ভালো চাহিদা থাকায় চাষ ও বিপণন একটি লাভজনক পেশায় পরিনত হয়েছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে কুঁচিয়া চাষ করা গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকার পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরর সুযোগ সৃষ্টি হবে। বাণিজ্যিকভাবে কুঁচিয়া চাষে প্রকল্প গ্রহণে মৎস্য অধিদপ্তর কাজ করছে। 
 

সম্পর্কিত বিষয়: