নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

রোববার,

২৮ এপ্রিল ২০২৪

পোস্টমর্টেম : নারায়ণগঞ্জে দুই দফায় ৫ দিনের অবরোধ

নারায়ণগঞ্জ টাইমস:

প্রকাশিত:২০:৫৮, ৬ নভেম্বর ২০২৩

পোস্টমর্টেম : নারায়ণগঞ্জে দুই দফায় ৫ দিনের অবরোধ

রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপি মহাসমাবেশ ও বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে আওয়ামীলীগের শান্তি সমাবেশ ঘিরে নারায়ণগঞ্জে ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে উঠে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা। দুই দল তাদের সমাবেশ সফল করতে নানা পন্থায় প্রস্তুতি গ্রহণ করে। চলে প্রস্তুতি সভাও। ওই সমাবেশ ঘিরে প্রকাশ্যে আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য বিবৃতিতে বিএনপিকে হুমকি-ধামকি দেয়। কিন্তু সকল হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে সমাবেশে ব্যাপক লোকসমাগমের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে বিএনপি। তবে পিছিয়ে ছিল না আওয়ামীলীগও। তারাও লোক সমাগমের প্রস্তুতি নেয়। শেষ পর্যন্ত আওয়ামীলীগ তাদের সমাবেশ সফল করতে পারলেও বিএনপির মহাসমাবেশ পন্ড হয়ে যায়। প্রতিবাদে বিএনপি ২৯ অক্টোবর সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করে। ফলে ওইদিন সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় হরতালের পক্ষে পিকেটিং করে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। টায়ারে ও সড়কে পেট্টোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে।

এক পর্যায়ে আড়াইহাজারে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ আন্তজার্তিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের নেতৃত্বে নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষেল ঘটনা ঘটে। সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ, বন্দরের মদনপুর, সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্টে এবং নারায়ণগঞ্জ শহরে আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হরতালের পক্ষে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের তৎপতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু ঘোষণা দিয়ে  মাঠে নামেনি আওয়ামীলীগ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে পুলিশের কঠোরতায় এক সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠ ছেড়ে দিলে মাঠে নামে হরতাল বিরোধী মিছিল নিয়ে আওয়ামলীগের নেতাকর্মীরা। তারা ফাঁকা মাঠে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা শ্লোগান দেয়। 


এদিকে সারাদেশে হরতালে সহিংসতা ও শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ৩১ অক্টোবর থেকে টানা তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। একইভাবে অবরোধের প্রথম দিনে আড়াইহাজারে পুলিশ ও আওয়ামীলীগের সঙ্গে বিএনপির ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে ৩ পুলিশসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়। একইভাবে সকালে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে ও পিছনে পুলিশের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ শহরে মহানগর যুবদলের নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। পরে পুলিশের টিয়ারসেল ও রাবার বুলেটের  কাছে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় যুবদলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা শহরের মিশনপাড়া ও ডনচেম্বারের সামনে উৎসব পরিবহনের একটি বাস ও বন্ধু পরিবহনের একটি বাস ভাংচুর করে। এবং উৎসব পরিবহনের বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে বাসের ৬টি সিট পুড়ে যায়। এছাড়া শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ও জেলার বিভিন্নস্থানে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পরে তারা রাজপথ ছেড়ে দেয় পুলিশের তৎপরতায়।

এরপর শহরের ২নং রেল গেইট এলাকায় আওয়ামলীগের কার্যালয়ের সমানে জেলা আওয়ামীলীগ ও মহানগর আওয়ামীলীগের একঝাক নেতাকর্মীকে অফিস পাহারা দিতে দেখা যায়। সেখানে তারা অবরোধ ও বিএনপির সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু বাস ভাংচুর ঠেকাতে পারেননি। একইভাবে ১ নভেম্বরও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজপথে বিভিন্ন পয়েন্টে মাঠে নামে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। গাড়ি ভাংচুর, সড়কে টায়ার ও পেট্টোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাশাপাশি বিক্ষোভ করে। অবরোধের শেষ দিন ২ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের ডাচবাংলা ব্যাংক ও মাদানি নগর এলাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মামুন মাহমুদের অনুসারী নেতাকর্মীরা টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।  এসময় পুলিশ সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক টিএইচ তোফাসহ ৪ জনকে আটক করে। একই সময় সিদ্ধিরগঞ্জের সাজেদা হাসপাতালের সামনে জেলা কৃষকদলের নেতাকর্মীরা ৩টি বাস ভাঙচুর ও টায়ারে অগ্নিসংযোগ করে। এবং ১০-১৫টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। সকাল ৬টার দিকে ফতুল্লায় থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মোঃ চৌধুরীর নেতৃত্বে  বিক্ষোভ মিছিল করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

১ নভেম্বর শহরের ২নং রেলগেইটে আওয়ামীলীগের অবস্থান
এদিন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নানের সমর্থকরা সোনারগাঁও উপজেলার মেঘনা নদীতে নৌপথ অবরোধ করে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে নেতাকর্মীরা। সকাল সোয়া ৬টার দিকে ছাত্রদল নেতা মাসুদুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা রূপগঞ্জের কুসাবো এলাকার এশিয়ান হাইওয়ে বাইপাস সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভু করে এবং একটি গাছ ভর্তি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান গতিরোধ করে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় পুলিশের শর্টগানের গুলিতে দুই ছাত্রদল কর্মী আহত হয়। দুপুরে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক রফিকুল ইসলাম ও সদস্য সচিব সালাহউদ্দিন সালুর নেতৃত্বে রূপগঞ্জে ঢাকা বাইপাস মহাসড়কে অবরোধের সমর্থনে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভ করে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা।  দুপুরে শহরের কালিবাজার এলাকায় নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউছুফ খান টিপুর নেতৃত্বে বিএনপির নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করে এবং একটি বাস ভাংচুর করে। 


এদিন সকালে বিএনপির নেতাকর্মীরা চলে যাওয়ার পর মাঠে নামে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগ। তারা শিমরাইল মোড়ের দক্ষিনদিকে অবস্থান নিয়ে মিছিল করে তাদের কাজ শেষ করে।

২ নভেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে আওয়ামীলীগ নেতাদের ফটোশেসন
এরপর দুইদিন গ্যাপ দিয়ে দ্বিতীয় দফায় ৫ ও ৬ নভেম্বর ৪৮ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এই দুইদিনও জেলার বিভিন্ন এলাকায় ও ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং এশিয়ান হাইওয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে সড়কে পেট্টোল ঢেলে ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পাশপাশি অবরোধের সমর্থনে ও সরকারের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এছাড়া অবরোধ শুরুর আগে ৪ নভেম্বর রাত পৌনে ১২টায় সাইনবোর্ড এলাকায় অনাবিল পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ৫ নভেম্বর সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁয়ে বিভিন্ন স্থানে সড়কে পেট্টোল ঢেলে ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। অবরোধ সফল করতে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি, জেলা ও মহানগর যুবদল। এছাড়া আড়াইহাজারে বিক্ষোভ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নজরুল ইসলাম আজাদের সমর্থকরা।


কিন্তু বিপুল সংখ্যক আইনশৃংখলাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অবরোধকারীরা যানবাহন মালিক ও চালকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। ভয় পেয়ে যায় সাধারণ যাত্রীরাও। ফলে দুরপাল্লার কোন বাস নারায়ণগঞ্জ অংশ দিয়ে চলাচল করেনি। বন্ধ থাকে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড ও শিমরাইল মোড় এবং নারায়ণগঞ্জ শহর ও আর্মি মার্কেটের সকল সকল দুর পাল্লার বাস কাউন্টিার। এতে করে দুরপাল্লার যাত্রীরা গন্তব্যে যেতে পারেনি। আঞ্চলিক পরিবহন যদিও চলাচল করেছে কিন্ত স্বাভাবিক দিনের তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল। তবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রূটের ট্রেনে যাত্রীদের উপচে পড়া ভীড় লক্ষ্য করা গেছে। অবরোধের শেষ দিন সোমবারও (৬ নভেম্বর) সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও আড়াইহাজারে আগুন জ্বালিয়ে মহাসড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যুবদলেল নেতাকর্মীরা। এছাড়া নগরীতে মহানগর বিএনপি ঝটিকা মিছিল করে। এদিনে বেলা ১১টার দিকে সাইনবোর্ড এলাকায় অবস্থান নেয় জেলা, মহানগর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বক্তব্য রাখেন। এছাড়া জাতীয় পাটির কোন নির্দেশনা না থাকলেও আজেমরী ওসমান হোন্ডা ও গাড়িবহর নিয়ে শহরে শান্তি মহড়া দিয়েছে। এতে শান্তির চেয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন খোদ সরকারদলীয় লোকজন।

    শহরে আজমেরী ওসমানের মহড়া                  
তবে দুই দফায় ৫দিনের অবরোধে পুলিশ সড়কে অবরোধকারীদের বিশৃংখলা পুরোপুরি ঠেকাতে না পারলেও মামলা, গ্রেপ্তার ও নেতাদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাকর্মীদের কাবু করতে পেরেছে। গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দেয় চিহ্নিত নেতাকর্মীরা। কিন্তু তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকটা ইঁদুর-বিড়াল খেলার মতো অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা বেলা বাড়ার পর ফটোশেসন করার জন্য মাঠে নেমে লম্ফঝম্ফ দেয়। অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে নানা শ্লোগান দেয় তারা। কিন্তু  যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে পারেনি তারা।  ফলে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভোর থেকে মাঠে ক্ষমতাসীনরা বেলা বাড়ার মাঠে। আর আইনশৃংখলাবাহিনী নিরাপদ দুরুত্বে থেকে অবরোধকারীদের প্রতিহত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। তবে আগামী ৮ ও ৯ নভেম্বর আবারো অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ওইদিন কেমন থাকবে নারায়ণগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি তা দেখার অপেক্ষায় নারায়ণগঞ্জবাসী।