নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪

স্মৃতিময় কবি আমজাদ হোসেন

মানুষটি ছিলেন নির্বিরোধ ও অজাতশত্রু

আহমদ তমিজ :

প্রকাশিত:০৭:২০, ১৫ আগস্ট ২০২১

মানুষটি ছিলেন নির্বিরোধ  ও অজাতশত্রু

গত ১লা আগস্ট কবি আমজাদ হোসেন আমাদের এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে এক অবিনশ্বর পৃথিবীতে চলে গেলেন, আমরা হারালাম একজন সৃজনশীল পরিশীলিত ও প্রাণবন্ত মানুষকে। তাঁর কিছু সংলাপ কিছু দৃশ্য আমার স্মৃতিপটে স্মৃতিময় হয়ে আছে।

 

খুব সম্ভব ৬৯-৭০ সালের কথা। আমরা ক’জন বন্ধু-বান্ধব মিলে নলুয়া পাড়ার কিশলয় লেখক গোষ্ঠীর অঙ্গ-সংগঠন নাট্যদীপ এর পক্ষ থেকে মাছুয়া বাজার এলাকায় ঐতিহাসিক ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি মঞ্চস্থ করছিলাম।  সেই সুবাদে সেই নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয়কারী আমজাদ ভাই আরেক নাট্যাভিনেতা চঞ্চল মাহমুদের সাথে পরিচিত হই। সে নাটকে ধুতি পরা আমজাদ ভাইয়ের সাবলীল অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়ে ছিল।

 

এক সময় আমিও বোস কেবিনের আফিম মেশানো চায়ে আসক্ত হয়ে পড়ি।  সেই সময় লক্ষ্য করতাম আমজাদ ভাই এক সময়ের কবি  সেলিম সারোয়ার, অধ্যাপক বুলবুল চৌধুরী, শরীফ সারোয়ার, কবি শাহেদ আলী মজনু, চিত্র অভিনেতা হাজী ওবায়েদ উল্লাহ (সাবেক পৌর কমিশনার ও প্যাণেল মেয়র), সাংবাদিক মোমতাজ আহমেদ, নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক তমিজউদ্দিন রিজভী, অভিনেতা ও পরিচালক আনোয়ার আশরাফ এর সাথে আবার মাঝে মাঝে  মোহাম্মদ ইসহাক, মোহাম্মদ নূরউদ্দিন সহ আরো অনেকে এক জমজমাট আড্ডায়  মেতে উঠতেন। চা নাস্তার সাথে দেশ বিদেশের রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, শিক্ষা ও অর্থনীতি নিয়ে চলতো আলোচনা সমালোচনা। কখনো কখনো সেই আড্ডায় আমারও উপস্থিত থাকার  সৌভাগ্য হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই-তাঁদের আড্ডা ( আসলে আলোচনা সমালোচনা ও পর্যালোচনা )  থেকে আমি প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম-আড্ডা একজন  প্রাণবন্ত সৃজনশীল মানুষের জন্য কতটা প্রয়োজন রয়েছে। তাঁদের থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম জেনেছিলাম। আমজাদ ভাই ছিলেন কেতাদুরস্ত স্টাইলিস্ট ম্যান। নিত্যনতুন জামা কাপড় তিনি সেই আড্ডায় আসতেন। মৃদুভাষী সদা হাস্যময় এই মানুষটি ছিলেন নির্বিরোধ ও অজাতশত্রু।

 

আশির দশকের শেষের দিকে আমি একজন আইনজীবী হিসেবে নারায়ণগঞ্জ জজকোর্টে (পুরাতন কোর্ট) যোগদান করি। একদিন বোস কেবিনে আমজাদ ভাইয়ের মুখোমুখি হলাম। তিনি বললেন, ‘গতকাল আপনাকে দেখলাম জজকোর্টের বাইরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে নূরউদ্দিন (সাবেক জিপি) এর সাথে কালো কোর্ট কোলো টাই পরে চা পান করছেন। দেখে আমার খুব ভাল লেগেছিল।’

 

আমজাদ ভাই কবিতা লিখতেন। তাঁর দু’টি কবিতার বই বেরিয়ে ছিল। তা দেখা বা পড়ার আমার সুযোগ না হলেও তার কিছু কবিতা স্থানীয় পত্রপত্রিকায় পড়েছি। কবিতার বিষয় বস্তু আবেগঘন প্রেম ও ভালোবাসা। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট উপন্যাসিক মানিক বন্দোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, ‘দু’টি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশের কেউ যেন বাংলা সাহিত্যের চর্চা করতে না আসেন।’ লেখকের বিশ্বাস সাহিত্য চর্চা লেখককে দারিদ্রতায় আচ্ছন্ন করে। আমজাদ ভাই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পিতার সন্তান ছিলেন। তিনি স্বাভাবিকভাবে পিতার রেখে যাওয়া ব্যবসাপাতিতে না জড়িয়ে একাধারে সহিত্য চর্চা, নাট্যচর্চা এবং সিনেমা পরিচালনার সাথে জড়িত হওয়া ছাড়াও  কলেজের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু চঞ্চলমতি ও আবেগ প্রবণ এই মানুষটি কোন কিছুতেই থিতু হতে পারেন নি।

 

 কোন এক সন্ধ্যায় একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি কোরআন এর ইংরেজী অনুবাদ নিয়ে তাঁর চাষাড়াস্থ বাসভবনে উপস্থিত হয়েছিলাম। তিনি খুব আদরের সাথে তা গ্রহণ করে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। রাস্তায় দেখা হলে তিনি আগে সালাম দিতেন। তিনি পবিত্র হজ্ব পালন করতে যাবেন। এ উপলক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে তাঁকে বিদায় সবংর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় আমার হাত দু’টি ধরে বললেন, ‘আমার জন্য দোয়া করবেন।’ আমিও তাঁর কাছ থেকে দোয়া চেয়ে নিয়েছিলাম।

 

বছর খানেক আগে নারায়ণগঞ্জের আরেক আলোকিত মানুষ  মোহাম্মদ ইসহাক ভাইয়ের স্মরণে সুধীজন পাঠাগারের পক্ষ থেকে স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে আমজাদ ভাইয়ের সুযোগ্য সন্তান আফজাল হোসেন পন্টি’র সঞ্চালনায় আমজাদ ভাই ইসহাক ভাইয়ের স্মৃতি অর্পন করে আবেগঘন বক্তব্য রেখেছিলেন।

 

পবিত্র কুরআন হাকিমে আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন, ‘কুল্লে নাফসুন জায়েকাতুল মউত।’ অর্থাৎ প্রত্যেক জাতিকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু এক অমোঘ বিধান-যার হাত থেকে আমরা কেউই পলায়ন করতে পারবো না। আমাদের সবাইকে নির্ধারিত সময়ে এই পৃথিবী ছেড়ে এক অনন্ত পৃথিবীতে চলে যেতে হবে। ঐশর্য্যময় বালাখানা সকল খ্যাতি-অখ্যাতি নিয়ে ফিরে যেতে হবে মহান আল্লাহর কাছে। দোয়া করি আল্লাহ যেন আমজাদ ভাইকে জান্নাতবাসী করেন।

 

সবশেষে কবি ফজল শাহাবুদ্দীন এর মৃত্যুচিন্তা নামক কবিতার কয়েকটি চরণ-‘মৃত্যু কিছুই নয় মৃত্যু মানেই এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে যাত্রা মাত্র। আমরা কেউ মরি না।’

 লেখক: আইনজীবী/ সাংবাদিক।