
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে হতাহত, সহিংসতা- নাশকতার রেশ কাটেনি এখনও৷ রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ আন্দোলনের পুরোটা সময়েই ছিল রণক্ষেত্র৷ দুষ্কৃতকারীদের নাশকতা ও নজিরবিহীন তাণ্ডবের কারণে আলোচনার শীর্ষে ছিল জেলাটি। এবার সংগঠিত সেসব নাশকতার দায়ে সাবেক বিএনপি নেতা ও ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়নের নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুকে গ্রেপ্তার দাবি করেছেন ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী জসিমউদ্দিন৷ জেলা পুলিশ সুপারের কাছেও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই দাবি লিখিতভাবে জানাবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
শনিবার (২৮ জুলাই) বিকালে কুতুবপুরের চিতাশালে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীসভায় তার এমন বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে জেলাজুড়ে।
সভায় জসিমউদ্দিন বলেন, ১৯ জুলাই রাতে সেন্টু চেয়ারম্যান, ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার মিন্টু, যুবদল নেতা শাকিল (নাশকতার দায়ে গ্রেপ্তার কাউন্সিলর ইসরাফিল প্রধানের ভাগ্নে) ভূঁইগড়ের এক বাড়িতে বিএনপির ক্যাডারদের নিয়ে মিটিং করে। জ্বালাও-পোড়াও, নাশকতা করতে সেন্টু বিএনপির ক্যাডারদের সেখানে পাঁচ লাখ টাকা দেন৷ ইউনিয়ন নির্বাচনের পরেরদিন ফতুল্লা আর কুতুবপুরের বিএনপির সব নেতাকর্মী কক্সবাজার গেছে। সেন্টু গেছে এর পরেরদিন, সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়ে মিটিং করেছেন। এরপরে আমি এমপি সাহেবের বাসায় গেলে এমপি আমাকে সেই মিটিংয়ের কথা জিজ্ঞেস করেন৷ আমি বলেছি, মিটিংয়ের ছবিও আছে আমার কাছে। সেই ছবি এমপি সাহেবের কাছেও আছে। এমপি তখন বললেন, সেন্টু একটা মীরজাফর৷ ও যে এতবড় বেঈমানি করবে আমার সাথে তা আমি কল্পনাও করিনি।
চেয়ারম্যান সেন্টুকে উৎখাত করতে হবে উল্লেখ করে জসিমউদ্দিন আরো বলেন, সেন্টুর বাড়ির সামনেই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ক্যাডারেরা অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠি হাতে জড়ো হয়ে এতোকিছু করলো। সেন্টু কি তা দেখেন নাই? তিনি চেয়েছিলেন ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎখাত করবেন। আমরা এবার কুতুবপুর থেকে সেন্টুকেই উৎখাত করবো৷ নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারকে বলতে চাই, সেন্টু চেয়ারম্যান ও মিন্টু মেম্বারকে গ্রেপ্তার করুন, তাহলেই এই নাশকতা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের সব রহস্য বের হয়ে যাবে৷ আমরা লিখিতভাবে তাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাবো এসপির কাছে।
সেন্টুকে অন্য দল থেকে এনে চেয়ারম্যান বানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকেই বলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে গেছেন। আমরা কিন্তু ঝিমিয়ে যাইনি৷ সেন্টুকে অন্য দল থেকে ধার করে এনে চেয়ারম্যান বানানো হয়েছে৷ আপন পোলায় বাপ ডাকে না, পরের পোলায় কি আর বাপ ডাকবে। সেন্টু কোনো বক্তব্যে জয় বঙ্গবন্ধু বলেন না। একবার এমপি তাকে বক্তব্য শেষে জয় বঙ্গবন্ধু বলিয়েছিলেন৷ এরপর ১৫ আগস্টে শোক দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি যখন জয় বঙ্গবন্ধু বললেন না, আমরা তার কাছে এর কারণ জানতে চাই। তখন তিনি বললেন, আমার দলীয় স্লোগান দিতে ভালো লাগে না। তিনি নিজেই বলেন, ফতুল্লা থানা বিএনপির অর্ধেক আর কুতুবপুর ইউনিয়ন বিএনপি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন৷ তাই আমি আজকে ঘোষণা দিলাম, আজকে থেকে আর প্রতিবাদ নয়, বিএনপি- জামায়াতকে প্রতিরোধ করতে হবে৷
প্রসঙ্গত, কুতুবপুরের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু ফতুল্লা থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক৷ ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনের আমেজ শুরু হলে তিনি শুরুতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ধানের শীষ প্রতীকের ছবিসম্বলিত পোস্টার ছাপিয়ে নির্বাচনী বার্তা দেন৷ পরবর্তীতে রহস্যজনক কারণে ধানের শীষ প্রতীক না নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। সেই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী গোলাম রসুল শিকদারকে পরাজিত করেন তিনি৷ গুঞ্জন উঠে, স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ইচ্ছাতেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হন সেন্টু। প্রায় পৌনে দুই লক্ষ ভোটার অধ্যুষিত ইউনিয়নটিতে বিএনপি নেতার বিজয় নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন বোর্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যা সেসময় জাতীয় দৈনিক সমকালসহ স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতেও প্রকাশিত হয়।
২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তুমুল বিরোধিতার পরেও সেন্টুর হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দেওয়া হয়। সেসময় ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সেন্টু আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সদস্যপদ নিয়েছেন, যদিও দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণাদি দেখাতে পারেননি থানার নেতৃবৃন্দ। ওদিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল মনোনীত দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করারও অভিযোগ উঠে। প্রতিদ্বন্ধী কোনো প্রার্থী না থাকায় এই দফায় বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় চেয়ারম্যান হন সেন্টু। থানা বিএনপির সাবেক এই সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে এর আগেও সরকারবিরোধী নাশকতা, জ্বালাও- পোড়াওয়ের মামলা রয়েছে৷ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে একটি নাশকতা মামলায় তাকে দায়ী করে চার্জশিট দেওয়া হলে তিনি চেয়ারম্যান পদ থেকে বহিস্কৃত হন, তবে পরবর্তীতে আইনী প্রক্রিয়ায় পদ ফিরে পান৷ সেন্টুর বিরুদ্ধে তৎকালীন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ নেতা শফিকুর রহমান মেছের হত্যাকাণ্ডসহ সরকারবিরোধী নাশকতা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের একাধিক মামলা রয়েছে।