নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শনিবার,

২৭ জুলাই ২০২৪

 লাঙ্গলবন্দে দুইদিন ব্যাপী মহাষ্টমী স্নানোৎসব শুরু

নারায়ণগঞ্জ টাইমস:

প্রকাশিত:১৩:২৭, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

 লাঙ্গলবন্দে দুইদিন ব্যাপী মহাষ্টমী স্নানোৎসব শুরু

নারায়ণগঞ্জের বন্দরের  লাঙ্গলবন্দে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুইদিন ব্যাপী মহাষ্টমী স্নানোৎসব শুরু হয়েছে। সোমবার (১৫ এপ্রিল) বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে তিথির লগ্ন শুরু হয়। শেষ হবে আজ মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৫৪ মিনিটে। হিন্দু শাস্ত্রীমতে"হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র, হে লৌহিত্য, আমার পাপ হরণ করো। এইমন্ত্র পাঠ করে ফুল, বেলপাতা, ধান দুর্বা, হরতকি, ডাব, আম, পাতা ও ফলের সমাহার দিয়ে পিতৃকুলের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেন হিন্দু ধর্মালম্বীরা। স্নানোৎসবে দেশ-বিদেশের ১০ লক্ষ্যের অধিক পূণ্যার্থীদের অংশগ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।


হিন্দু পুরাণ মতে, শান্তনু মুনির পত্নী অমোঘা দেবী ব্রহ্মার তেজ গর্ভে ধারণ করে এক সুন্দর পুত্রসন্তান প্রসব করেন। প্রসবের আগে মুনি উত্তরে কৈলাস, পূর্বে সম্বর্তক, দক্ষিণে গন্ধমাদন ও পশ্চিমে জারুধি-এই চার পর্বতের মধ্যে একটি কুণ্ড খনন করে রাখেন।


প্রসবান্তে পুত্রটিকে সেই কুণ্ডে স্থাপন করেন এবং ব্রহ্মা এসে ওই পুত্রকে দেখে নাম রাখেন ‘লোহিত্য’। কিছুদিন পর পুত্র জলে দেহ বিস্তার করে কুণ্ডের মধ্যে অবস্থান করেন। সেই থেকে এর ‘নাম হয় ব্রহ্মকুণ্ড’। ত্রেতাযুগে জমদগ্নি নামে এক মুনি ছিলেন। রেণুকার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের ছিল পাঁচ পুত্রসন্তান। কনিষ্ঠ সন্তানের নাম হলো পরশুরাম, বিষ্ণুর দশম অবতারের মধ্যে ষষ্ঠ অবতার। একদিন মুনি জমদগ্নি, স্ত্রী রেণুকার জল আনতে বিলম্ব হলে বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করেন এবং যোগবলে তার মানসিক বিকৃতির কথা অবহিত হন। ক্রোধান্বিত হয়ে মুনি রূঢ়স্বরে তার পুত্রদের তাদের মাকে হত্যা করার আদেশ দেন। অগ্নিশর্মা মুনির এ আদেশ প্রথম চার পুত্রের কেউই পালন করতে রাজি হননি। পরে পঞ্চমপুত্র পরশুরাম পিতার আদেশে কুঠার দিয়ে মায়ের দেহ দ্বিখণ্ডিত করেন। কিন্তু পরশুরামের হাতে কুঠারটি লেগে থাকে। পিতার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে পিতা বলেন-‘তুমি মাতৃহত্যা আর নারীহত্যা এই দ্বিবিধ পাপেই আক্রান্ত হয়েছো। আর জেনে রেখো, পাপ ছোট বা বড় যাই হোক না কেন, কৃতকর্মীকে তা স্পর্শ করবেই।’


তারপরও পুত্রকে আশ্বস্ত করে তীর্থ পরিভ্রমণের উপদেশ দিয়ে বলেন-‘যে তীর্থ গমনে বা স্নানে তোমার হাতের কুঠার স্খলিত হবে, জানবে ওই পুণ্যস্থানই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র।’ পিতৃ-আজ্ঞায় পরশুরাম তীর্থ পরিভ্রমণে বের হয়ে বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণ করতে লাগলেন। পরশুরাম ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের কুঠার স্খলিত হয়ে যায় এবং তিনি সর্বপাপ থেকে মুক্তি লাভ করেন। তিথিটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথি, বুধবার পুনর্বসু নক্ষত্র।


পরে পরশুরাম চিন্তা করলেন-এমন পুণ্য জলকে সবার সহজলভ্য করার জন্য এর ধারা পৃথিবীতে নিয়ে আসবেন। পিতৃ-আজ্ঞায় ব্রহ্মকুণ্ডের জলধারাকে এ পৃথিবীতে নিয়ে আসেন স্খলিত কুঠার দিয়ে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত। তারপর লাঙ্গল দিয়ে মাটি কর্ষণ করে তা নারায়ণগঞ্জ জেলার লাঙ্গলবন্দ পর্যন্ত নিয়ে আসেন। সেজন্য পুণ্য এ তিথিতে লাঙ্গলবন্দের জলে স্নান করা অত্যন্ত পুণ্যের বলে বিশ^াস করে সনাতন হিন্দুধর্মালম্বীরা। এই স্নানের ফলে ব্রহ্মার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে পাপমোচন হয়। এ বিশ্বাস নিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে পরশুরামের পাপ থেকে মুক্তি হওয়ার কথা স্মরণ করে শত শত বছর ধরে লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমী স্নান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। 


যার দিন তারিখ কারো নির্দিষ্টভাবে জানা নেই। তাই প্রতিবছর উৎসবমুখর পরিবেশে লাখো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পথচারণায় মুখরিত হয় লাঙ্গলবন্দ।  নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার ললিত সাধুর আশ্রম থেকে বন্দর লোকনাথ মন্দির পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে ২০টি ঘাটে লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে শুরু হয়েছে হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই মহাঅষ্টমী স্নান উৎসব। প্রতিবছরের মত এ বছরেও বাংলাদেশ সহ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পূণ্যার্থীরা পাপ মোচন ধুয়ে মুছে যাবে সন্তান ও পরিবারের মঙ্গল কামনায় এই প্রার্থনা করে স্নান উৎসবে অংশ নিয়েছে পূণ্যার্থী।


পুণ্যার্থীদের স্নান ঘাটগুলো হলো, ললিত সাধুর ঘাট, নাসিম ওসমান কেন্দ্রীয় স্নানঘাট, গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া স্নানঘাট, জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি স্নানঘাট, অন্নপূর্ণা স্নানঘাট, লাঙ্গলবন্দ রাজঘাট, মাকরী সাধুর শান্তি আশ্রম স্নানঘাট, গান্ধী ঘাট বা মহাশ্মশান স্নানঘাট, বরদেশ্বরী কালী ও শিব মন্দির স্নানঘাট, জয়কালী মন্দির স্নানঘাট, রক্ষা কালীমন্দির স্নানঘাট, পাষান কালীমন্দির স্নানঘাট, স্বামী দ্বিগিজয় ব্রক্ষচারী আশ্রম প্রেমতলা, শ্রী রামপুর জগদ্বন্ধু স্নান ঘাট (ব্রক্ষা মন্দির), দক্ষিণেশ্বরী কালী মন্দির স্নানঘাট,পরেশ মাহাত্মা আশ্রম স্নানঘাট, সাব্দী রক্ষা কালীমন্দির স্নানঘাট, সাব্দী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম স্নান ঘাট ও পঞ্চ পান্ডব স্নানঘাট (কালীগঞ্জ ঘাট) ও শ্রী প্রভুপাদ স্নানঘাট।


নারায়ণগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিখন সরকার শিপন জানান, মাসখানেক আগে থেকে উৎসবকে কেন্দ্র করে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। দেশের আবহাওয়াও অনুকূলে আছে। তাছাড়া প্রশস্ত করা হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। তার কারণে দুদিন আগে থেকে দেশ-বিদেশের পূণ্যার্থীরা আশ্রয় কেন্দ্রে অংশগ্রহণ করেছে। এবারে স্নানোৎসবে ১০ লক্ষ্যের অধিক পূণ্যার্থীরা অংশগ্রহণ করেছে। 

 

লাঙ্গলবন্দ মহাষ্টমী স্নান উদযাপন কমিটির সরষ কুমার শাহা জানান, এবার ২০টি স্নান ঘাট পুণ্যার্থীদের জন্য সংস্কার করা হয়েছে। বিশুদ্ধ খাবারের জল সরবরাহের জন্য ১৬টি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। বিপুলসংখ্যক কাপড় পরিবর্তন কক্ষ, ১৫০টি অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ করেছে জেলা প্রশাসন।  এছাড়া ব্রহ্মপূত্র নদের কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, ৫টি মেডিকেল টিম ও নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস ১০ শয্যাবিশিষ্ট অস্থায়ী হাসপাতালের ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়াও দর্শনার্থীদের সেবা নিশ্চিতে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠনের পক্ষ থেকে ৬০টি সেবা ক্যাম্প স্থাপন ও ৪০০ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। যেখানে বিশুদ্ধ পানি, খাবার, শিশু খাদ্য এবং মেডিকেল ক্যাম্প সহ তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষে পুরো ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১০০টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।  


এদিকে ২০১৫ সালে সরু রাস্তা ও অতিরিক্ত মানুষের চাপে স্নান উৎসবে আসা ১০ পূণ্যার্থী পদদলিত হয়ে মারা যায়। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনা বিবেচনা করে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পুলিশ, র‌্যাব, আনসার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যে কোন বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে রাখা হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ওয়াচ টাওয়ারের পাশাপাশি পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। 


নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, সনাতন ধর্মালম্বীদের স্নান উৎসবকে কেন্দ্র করে পুলিশ, র‌্যাব ও সাদা পোশাকসহ ১ হাজার ৫০০ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুরো এলাকাজুড়ে ১শ’য়ের অধিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনিটরিং সেল বসানো হয়েছে। পুণ্যার্থীদের যাতায়াত নির্বিঘ্নে করতে মহাসড়ক ও সড়কে অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি নদীতে নৌপুলিশ কাজ করছে।
 

সম্পর্কিত বিষয়: