নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শনিবার,

২০ এপ্রিল ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক ধর্ষিতা নারীর উপাখ্যান রাজাকার কন্যা

প্রকাশিত:২৩:৩৯, ৩১ মার্চ ২০২১

মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক ধর্ষিতা নারীর উপাখ্যান রাজাকার কন্যা

সাদত আল মাহমুদ এ সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। ইতোমধ্যেই তার বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও ছোটদের জন্য লেখা বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৭ সালের বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে তার প্রকাশিত উপন্যাস ‘রাজাকার কন্যা’ পাঠকমহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছে।

 

ইতোমধ্যেই উপন্যাসটির তৃতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে। এবার চতুর্থ মুদ্রন প্রকাশিত হল। ১৯২ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির পরতে পরতে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সংগ্রামের অন্তরালে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত ও সম্ভ্রমহানীর করুণ ও চোখে জল আনা কাহিনি।

উপন্যাসের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের পর বিধ্বস্ত পুরোনো ঢাকার বর্ণনা উঠে এসেছে। এরপর উপন্যাসের বিস্তার শুরু। গ্রামের যুবক আকবর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। যদিও সে সময় তার ঘরে অসহায় বৃদ্ধা মা ছিলেন এবং বাবাকে পাকমিলিটারিরা হত্যা করে।

 

এরপরেও তিনি সবকিছু ফেলে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কঠিন বিপদে পড়ে আকবর তিন সহযোগীসহ প্রখ্যাত রাজাকার নাজমুলের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় রাজাকার নাজমুলের কন্যা তাহমিনা পাকিস্তানি হানাদারদের থেকে কৌশলে আকবরসহ অন্যদের জীবন রক্ষা করেন।

 

তারপরই দেশের অসংখ্য মা-বোন-স্ত্রী-কন্যার মতো তাহমীনাকেও পাকিস্তানি হানাদারেরা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে দীর্ঘসময় ধরে তাহমিনা পাক আর্মি ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন ও গণধর্ষণের শিকার হয়।

 

যুদ্ধশেষে তাহমিনা বীরাঙ্গনা জেনেও কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে সমাজের তীর্যক দৃষ্টির বুকে পাড়া দিয়ে তাহমিনাকে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে আকবর নিজের করে নিয়ে আসেন।

 

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময়ে ঘটে যাওয়া সবকিছুই আকবর স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়, কিন্তু যাপিত জীবনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাহমিনার পেটে ধীরে ধীরে আশ্রয় করে নেওয়া পাকসেনাদের উচ্ছিষ্ট। একপর্যায়ে আকবর ও তাহমিনার সংসারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। সংসারে ফাটল ধরে।

 

আকবর ও তাহমিনার সংসারেও অবিশ্বাস-হতাশা বড় হয়ে দেখা দেয়। অনাগত পাকিস্তানি রক্তপিন্ড তাহমিনার শরীরে বড় হতে থাকে। একদিন তাহমিনা একজন কন্যা সন্তানের জননীও হলেন। কন্যার নাম রাখা হলো বিলকিস।

বিয়ের দিনক্ষন চূড়ান্ত হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে বিলকিস আরিফের মা খাদিজা বেগমকে অমসৃন অতীতের তিক্ত কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করে। এক পর্যায়ে বলাও শুরু করে। শুনুন, আমি আকবর সাহেবের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিনি।

 

হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পেই আমি মায়ের গর্ভে আসি। আমার পিতা কে আমি জানি না। আমার মাও জানে না। পিতৃপরিচয়হীন কাউকে সমাজ স্বীকৃতি দেয় না। আমি সমাজের এই অমসৃণ ধাপগুলো পার হওয়ার জন্য আকবর সাহেবকে পিতার আসনে বসিয়েছি।

আমি পাকিস্তানি আর্মিদের ঘৃণা করি এ জন্য যে, আমি হানাদার বাহিনীর ফসল। আমি আমার নানাকে চরমভাবে ঘৃণা করি এটা ভেবে যে, তিনি ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী। কিন্তু আমি আমার মাকে বিশাল আকাশের মতো সম্মান করি।

 

তিনি তার সতীত্বের উপর হামলা হবে জেনেও তিনজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের সতীত্ব বিকিয়ে দিয়ে হয়েছেন বীরাঙ্গনা। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন রক্ষা করে হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা।

 

আমার মাও মহান মুক্তিযোদ্ধা। আমি তাকে সারাজীবন স্যালুট করব। তিনিই এ পৃথিবীতে আমার একমাত্র গর্বের জায়গা।

 

এসব কথা শোনার পর আরিফ ও খাদিজা বেগম আর একটু সময়ও অপেক্ষা করেনি। উপরোন্ত কিছু কটু কথা শুনিয়ে বিদায় নেন।

উপন্যাসের চরিত্র মুক্তিযোদ্ধা আকবর, তাহমিনা, বিলকিস এদের হাত ধরে কাহিনি এগিয়ে গেছে। আর পরতে পরতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রণাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও দেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বর্ণিত হয়েছে।

‘রাজাকার কন্যা’ সাদত আল মাহমুদের লেখা অসাধারণ একটি ইতিহাসআশ্রিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো একটি উপাখ্যান যা পাঠকহৃদয়ে স্থায়ী দাগ ফেলবে বলে আমার বিশ্বাস।

 

মশিউর রহমান শিশুসাহিত্যিক ও প্রকাশক