নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪

নারায়ণগঞ্জে পারিবারিক কলহে বাড়ছে নৃশংসতা 

নারায়ণগঞ্জ টাইমস:

প্রকাশিত:০৮:০৪, ৬ জুন ২০২১

নারায়ণগঞ্জে পারিবারিক কলহে বাড়ছে নৃশংসতা 

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মায়ের হাতে সন্তান খুন, ফতুল্লায় চলন্ত গাড়ি থেকে স্বামীকে ফেলে দিয়ে হত্যা ও সোনারগাঁয়ে ভাইয়ের হাতে ভাই খুনের ঘটনা পারিবারিক বন্ধনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, মাত্র একদিনের ব্যবধানে নৃশংস এই তিনটি হত্যাকান্ডে প্রশ্ন উঠেছে নিরপত্তা নিয়ে৷ প্রশ্নের মুখে পড়েছে পারিবারিক সম্পর্কও৷ এ ধরনের নৃশংস হত্যাকান্ড কেন বাড়ছে?


ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৮টা। প্রতিদিনের মতো কর্মক্ষেত্র থেকে বাসায় ফিরে ঘর তালাবদ্ধ দেখতে পান সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্ধা ছগীর আহমেদ। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে হতবিহবল হয়ে পড়েন। রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে তার একমাত্র সন্তান নাজমুস সাকিব নাবিল। শরীরে ধারালো অস্ত্রের ২০/২৫টি ক্ষতচিহ্ন। 


ছেলের এই অবস্থায় কিছুক্ষণের জন্য হিতাহিত জ্ঞান হারালেও পরক্ষণেই তার স্ত্রীর খোঁজ করেন ছগির আহমেদ। স্ত্রীর সন্ধান না পেয়ে ছেলেকে দ্রুত সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ডের প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতালে নিয়ে যান।  অবস্থার অবনতি ঘটলে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ধানমণ্ডি হেলথ কেয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়ার সময় পথেই মারা যায় সাকিব। এ ঘটনার পর থেকেই পলাতক ছিলেন নিহতের মা নাসরিন আক্তার। নাসরিন আক্তারকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের ছগীর আহমেদ। গত ৩০ মে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী এলাকায় এমন নৃশংস ঘটনা ঘটে।


ছগীর আহমেদ বলছিলেন, আমার স্ত্রীর মানসিক সমস্যা রয়েছে। তিনি প্রায়ই বিভিন্ন ঘটনায় রাগারাগি করে বাসার জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন। তিনি ছেলের হত্যাকারী হিসেবে স্ত্রীকে আসামী করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু ঘটনার পরদিন নরসিংদী শহরের নিরালা নামক আবাসিক হোটেল থেকে অভিযুক্ত মা নাসরিন আক্তারের (৪৫) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। 


একইদিন রাত সাড়ে ১০টায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভুইগড় এলাকায় ইয়াসিন দুলাল। শিবু মার্কেট থেকে ইয়াসন দুলাল ও তার স্ত্রী আয়শা আক্তার কেয়া ইজিবাইকে উঠে। পথিমধ্যে তাদের দুজনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হলে ইজিবাইক চালক তাদের নেমে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ভুইগড় এলাকায় যেতেই আয়েশা আক্তার কেয়া দুলালকে ধাক্কা দিলে তিনি পড়ে গিয়ে কাভার্ডভ্যানের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরক্ষণেই কেয়া পালিয়ে যান। এ ঘটনায় নিহত দুলালের বাবা বাদী হয়ে আয়শা আক্তার কেয়াকে আসামী করে ফতুল্লা মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। কেয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানায় পুলিশ। 
 
এই দুটি ঘটনার একদিন পূর্বে সোনারগাঁয়ের জামপুর ইউনিয়নের গুদারাঘাট গ্রামে তিন ভাইয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তি হয়। এসময় ছোট এক ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে বড় ভাই কিরণের মৃত্যু হয়। নিহত কিরণ মাদকাসক্ত ছিল। সে তার বাবাকে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করতে গেলে ছোট ভাই মেহেদী হাসান ও গাব্বা তার বাবাকে বাঁচাতে গেলে ঘটনাটি ঘটে। 
  
জেলা পুলিশের সূত্রমতে, গত মে মাসে পুরো জেলা জুড়ে ৮টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। যারমধ্যে পারিবারিক কলহ ও দ্বন্দ্বের কারণে এরকম ৫টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও  একই কারণে ঘটছে একাধিক আত্মহত্যার ঘটনা। 
২৬ মে ফতুল্লায় পারিবারিক কলহের জের ধরে তানজিদা আক্তার পপি (২৫) নামে এক গৃহবধূকে ছুরি দিয়ে গলাকেটে হত্যার অভিযোগ উঠে তার স্বামী হীরা চৌধুরীর বিরেুদ্ধে। ওইদিন ভোরে ফতুল্লার পূর্ব লামাপাড়া এলাকায় হীরা চৌধুরীর নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

২৪ মে   নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় কাজলী আক্তার (২৩) নামে এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বিয়ের পর থেকে তাদের মধ্যে পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ে কলহ চলছিল। সেই কলহের জের ধরে কাজলী আত্মহত্যা করেছে বলে জানান নিহতের মা লতা  
 
১৪ মে  পারিবারিক কলহের জেরে সিদ্ধিরগঞ্জে স্বামীর হাতে বিবি ফাতেমা (৪৫) নামে এক নারীর হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওইদিন নিহতের ছেলে মিলন বাদী হয়ে নিহতের স্বামী সবুজের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরদিন দিনগত রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
 
  
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কোন কারণে মতের অমিল হলে বা বিরোধ হলে সেটা কেন হত্যার পর্যায়ে যাচ্ছে? মানুষের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের খুন করার এই প্রবণতা কেন? এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় আইনজীবী জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক কোষাধ্যক্ষ কামাল হোসেনের সাথে। 

আইনজীবী কামাল হোসেন বলেন, পারিবারিক কলহের জেরের এই সকল ঘটনার বেশির ভাগ মামলা কয়েক বছর পর পরিবারের মধ্যেই আপোষ-রফা করে ফেলা হয়। ১০-১২ বছর ধরে মামলা চালিয়ে রায় পাওয়া পর্যন্ত খুব কম মামলা চলে বলে আমাদের কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি। বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় লাগার কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তাৎক্ষনিক যে মানসিক অবস্থা থাকে সেটা কেটে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কয়েক বছর পর তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে আদালত থেকে মামলা তুলে নেয়। 
 
 নারায়ণগঞ্জ পুলিশের অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আমীর খসরু এই বিষয়ে বলেন,  পারিবারিক কলহে গত মে মাসে একাধিক হত্যাকান্ড  ঘটেছে। পারিবারিক কলহের পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। দাম্পত্য কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদকাসক্ত এসব বিষয় রয়েছে হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রধান কারণ। তবে এর বাইরেও আরো অনেক কারণে পারিবারিক কলহ হয়। করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনেতিক অস্বচ্ছলতাও পারিবারিক বিরোধের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। এ সকল ঘটনা বন্ধ করার জন্য আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে হবে। 

আরও পড়ুন :সিদ্ধিরগঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে বাড়ছে অপরাধ