নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

রোববার,

২৮ এপ্রিল ২০২৪

‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ : সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি থাকছেই 

কামাল উদ্দিন সুমন

প্রকাশিত:২০:৪৮, ২৯ আগস্ট ২০২৩

‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ : সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি থাকছেই 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম পরিবর্তন করে  ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ’ করা হয়েছে। আইনটি সংসদে পাশ হওয়ার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রী পরিষদ সভায় ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রস্তাবনাকে আমলে না নেয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। 


অনেকে বলছেন আগের আইনটির নাম পরিবর্তন হয়েছে তবে  যা ‘নতুন বোতলে পুরাতন মদই। এ ধরনের আইন মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। হয়রানিমূলক এই আইন অনুমোদন দেওয়ায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন অনেকে। তবে আইনমন্ত্রী বলছেন,‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ এর খসড়া চূড়ান্ত করার আগে অংশীজনদের মতামত নেওয়া হবে ।


আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখে সংসদ ডাকা হয়েছে। আইনটি যাতে সংসদে যেতে পারে, সেজন্য আইনটির বিষয়ে সোমবার মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে অবশ্যই অংশীজনদের ডেকে আলাপ-আলোচনা করা হবে। সেটা হবে, আপনারা আমার কাছ থেকে জানতে পারবেন। আলোচনার কথার যে কথা, সেটা আলোচনা করা হবে।


একজন পেশদার সংবাদকর্মী হিসেবে আমার ভয়টা অন্যজায়গায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময় সরকারের সংশ্লিষ্টজনরা বলেছিলেন,এআইনে সাংবাদিকদের কোন ক্ষতি হবে না। তবে আইনটি পাশ হওয়ার পর আমারা দেখলাম সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। মামলার আসামী হয়েছেন জেলে খেটেছেন এখনো জেল খাটছেন। সবচেয়ে হয়রানির শিকার হয়ে সাংবাদিরা যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে কথা তুলেছেন, দেশ বিদেশ সমালোচনা হয়েছে। তখন কৌশলে নাম পরিবর্তন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। 


সাইবার নিরাপত্তা আইনের যতটুকু বিশ্লেষণ করার সুযোগ হয়েছে। সে দৃষ্টিতে বলতে পারি সাইবার নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকতারকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। হয়রানির মাত্রা আরো বাড়বে। 


কারন সাইবার নিরাপত্তা আইনে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও তল্লাশির সুযোগসহ নিপীড়নমূলক সব ধারা বহাল রেখে এবং অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই মন্ত্রিসভায় এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।


জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ, মতামত ও প্রস্তাবনা উপেক্ষা করে আইনটির চূড়ান্ত অনুমোদন সরকারের দমনমূলক  মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। 


সাংবাদিকদের জন্য এ আইনের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় সাব-ইন্সপেক্টর মর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়া। এ ধারাটি আইনের অপপ্রয়োগের সবচেয়ে ভয়ংকর হাতিয়ার। এটি আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আছে, এখন আবার সাইবার সিকিউরিটি আইনেও রাখা হয়েছে। 


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৫ (মিথ্যা বা আপত্তিকর তথ্য প্রকাশ), ধারা ২৯ (মানহানিকর তথ্য প্রকাশ) এবং ধারা ৩১ (আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো বা উস্কানি) সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় অবিকৃত রয়েছে। 


২৫ ধারায় ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুন্ন’ সংক্রান্ত কোনো ব্যাখ্যা নেই। এসব ধারার যথেচ্ছ অপব্যবহার হতে দেখা গেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। সাইবার আইনেও কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়া এসব বিধান যুক্ত করা হয়েছে। বিএফইউজে এসব ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছিল।


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশিরভাগ ধারা হুবহু থাকা এ আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য থাকছে। অন্য ধারাগুলো জামিনযোগ্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। জামিনযোগ্য করা বা শাস্তি কমানোর মাধ্যমে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হবে না। কারণ কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করে জামিন না দিয়ে জেলে দীর্ঘ সময় আটকে রাখার অনেক দৃষ্টান্ত আগেও রয়েছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইনটি কার্যকর হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করবে এবং ভয়ের পরিবেশ অক্ষুন্ন থাকবে। 


শুধু খোলস পরিবর্তন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দেশি-বিদেশি উদ্বেগ ও জনগণের ভয়-শঙ্কা কাটবে না। ডিজিটাল আইনের সঙ্গে এর কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। কিছু ক্ষেত্রে সাজার মেয়াদ কমানো বা জামিনযোগ্য করা আইওয়াশ মনে করেন অনেকে। 


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শিশু, কিশোর, নারী, বয়স্ক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের ওপর সীমাহীন নিপীড়ন চালানো হয়েছে। যে কারণে সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন এমনকি সাধারণ মানুষও ডিজিটাল আইনটি বাতিল চেয়েছিল।  তবে সরকার সাইবার সিকিউরিটি আইন নাম দিয়ে দমন-নিপীড়নের হাতিয়ারটি একইভাবে রেখে দিয়েছে।


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) পরিবর্তে প্রস্তাবিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ যেন কোনোভাবেই স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সরকার বলছে, অনেকগুলো ধারা যেগুলো আগে অজামিনযোগ্য ছিল, সেগুলোকে সাইবার সিকিউরিটি আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তিও কমানো হয়েছে।


আইনমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা, যেমন মানহানির যে ধারাটা ছিল, সেই ধারায় আগে শাস্তি ছিল কারাদÐ। সেই কারাদÐের জায়গায় এখন জরিমানার বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ মানহানির একমাত্র সাজা জরিমানা। এখন জরিমানা যদি না দেওয়া হয়, তাহলে কারাদÐ থাকবে। সেটাও জরিমানার ওপর ভিত্তি করে তিন মাস বা ছয়মাসের কারাদÐ থাকবে। কিন্তু মূল শাস্তি হচ্ছে জরিমানা। জরিমানা আগে সর্বোচ্চ ছিল ৫ লাখ টাকা, এখন তা বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।’


তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি যেভাবে নিবর্তনমূলক এবং কণ্ঠরোধ ও ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল, তা সরকার অনুধাবন করেই আইনটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনটি যেন শুধু সাইবার অবকাঠামোর নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। নতুন আইন যেন কোনোভাবেই সাইবার অবকাঠামো তথা ডিজিটাল প্ল্যাটফম ব্যবহার করে স্বাধীন ও ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা না হয়- তা নিশ্চিত করতে হবে।


তবে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে । আমাদের ভয় আইনমন্ত্রী বলেছেন- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বহু ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনে যুক্ত হবে। সাংবাদিকদের  আশঙ্কার জায়গা ঠিক সেখানেই।

কামাল উদ্দিন সুমন 

সিনিয়র সাংবাদিক
প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক 
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)

সম্পর্কিত বিষয়: