নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪

৩ টি খুন, প্রায় ২ ডজন গুরুতর আহত : থামছেনা রক্তক্ষয়ী সংঘাত 

সন্ত্রাসী আতংকে বন্দরবাসী, অধিকাংশ খুনের নেপথ্যে “বড় ভাই”

নারায়ণগঞ্জ টাইমস

প্রকাশিত:২০:৩৭, ৩১ মে ২০২৩

সন্ত্রাসী আতংকে বন্দরবাসী, অধিকাংশ খুনের নেপথ্যে “বড় ভাই”

হঠাৎ করে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের দৃশ্যপট যেন পাল্টে গেল। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্ক্রিয়তা, অপরাধ জগতের লোকদের সাথে গোপন সখ্যতাই এর মূল কারন বলে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন মহল। দুই রাজু, জনি, রমজান, বাহিনীর আতংকে বন্দরবাসী। ৩ টি খুন প্রায় ২ ডজন গুরুতর আহত এমনকি অনেকে এখনো হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছে।  


বন্দরের দক্ষিনাঞ্চল নাসিক ২২, ২১, ২০,১৯ নং ওর্য়াডসহ কলাগাছিয়া ও বন্দর ইউনিয়নের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এই চক্রটি। আধিপত্য বিস্তার, হত্যাকাণ্ড, মাদক, নদী পথে ডাকাতি,  তেলে চুরি, ড্রেজার ও নদীতে রাখা ব্লকহেড প্রতি টাকা, ও ডিস লাইন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি নিয়ে ক্রমশ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের লাগাম টানা যাচ্ছে না কিছুতেই। 


উল্টো বন্দর ঘিরে গড়ে উঠছে বিভিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, যারা বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় অশান্ত করে তুলেছে। একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে। এই চক্রটি এতটাই চতুর ও ত্রাসী বাহিনী চুন থেকে পান কষলেই আগ্নে অস্ত্র ব্যবহার আর দাড়ালো অস্ত্র (বগি) দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপায়।


বন্দরে গত পৌন দুই মাসে ২ টি ও ১৭ সালে যে হত্যা কান্ডের ঘটনা ঘটেছে তা একই সূত্রের ও ওই বাহিনীর হাতে ঘটেছে।  প্রতিটি হত্যাকান্ডই দাড়ালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে করেছে। যা একটু বিশ্লেষণ করলেই প্রমাণ হবে বলে মন্তব্য করেন সুশীল সমাজ।  

 

সূত্র মতে, হত্যাকাণ্ড, মাদক, বালু, ড্রেজার,  নদী নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি তেল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির এই সহিংসতার নেপথ্যের কারণগুলো কী? কারা রয়েছে এর পেছনে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।


এই সন্ত্রাসী বাহিনীটি ২০১৭ সাল থেকে লোমহর্ষক এক হত্যাকান্ড দিয়ে এলাকায় নিজেদের জাহির পূর্বক আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছে। আনিছ জামায়াত ইসলামীর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেতে কৌশলগত ভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স হয়ে কাজ শুরু করে। 


সোর্স আনিছ ওই সুযোগে সখ্যতা করে অপরাধ জগতের লোকদের সাথে।  সাবদীতে ড্রেজার ব্যবসাসহ সকল সেক্টর থেকে মাসোয়ারা নেওয়া। পরবর্তীতে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলে সোর্স আনিছের বিরুদ্ধে কৌশল আটেন লুৎফর রহমান, মাসুম, সুজন ও উজ্জ্বল ওরফে নাডা উজ্জ্বল। 


সাবদীসহ কলাগাছিয়া ইউনিয়নের অনেক এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া জয়ে উঠে তারা। সুকৌশলে তারা একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ তৈরি করে।  তারা বেছে নেন নূরবাগ এলাকার রাজু ওরফে স্ট্যান্ড রাজু, সাদ্দাম ও নাডা উজ্জ্বলকে। তারা আবার কিশার গ্যাং সিফাত ওরফে কাটা সিফাত, ইমনদের দিয়ে বিশাল একটি বাহিনী গঠন করে। 


ক্ষমতাসীন দলের নেতা খান মাসুদের ব্যানারে লুৎফর রহমান, মাসুম, সুজনরা বন্দর ১ নং খেয়াঘাট থেকে আমিন, রুপালী, র্যালীসহ বেশ কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের প্রয়োজনে একটা সাইড দেয় স্ট্যান্ড রাজুকে। স্ট্যান্ড রাজু জীবন শুরু  বেবর চালিয়ে। 


তারপর সুকৌশলে দখলে নেই বন্দর ১ নং খেয়াঘাটের অটোরিকশার সেক্টর। ওইদিকে বড় ভাইদের সার্পোট পেয়ে রাজু গঠন করে একাধিক বাহিনী। স্ট্যান্ডের সাদ্দাম, উজ্জ্বল ওরফে নাডা উজ্জ্বল, ইমনদের নিয়ে দখল প্রক্রিয়া শুরু করে। স্ট্যান্ড রাজু ও চিনারদি রাজু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।  


নিজেদের স্বার্থ হাসিলে বড় ভাইয়েরা কৌশলে দুইজনকে বন্ধু থেকে চরম শত্রুতে তৈরি করেন। দুই রাজুর মধ্যে ২০১৭ সালের পর একাধিক বার মারামারি ঘটনা ঘটেছে।  যার মামলাও হয়েছিল একাধিক।  চিনারদির রাজুকে এলাকা বাগ করে দিয়ে সাবদী হতে কলাগাছিয়া পর্যন্ত সকল নিয়ন্ত্রণে নেই বড় ভাইদের পেটুয়া বাহিনীর প্রধান স্ট্যান্ড রাজু, উজ্জ্বলকে।


দ্বিতীয় মিশনে পড়েন সোর্স আনিছ। ৩ লাখ টাকা কন্টাকে আনিছকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আমিনের রোজা বেকারির গল্লী দিয়ে লুৎফর রহমানের সামনে থেকে সেই টাকা নিয়ে যায় স্ট্যান্ড রাজু, সাদ্দাম ও নাডা উজ্জ্বল। সেই আনিছ হত্যা মামলা হতে কৌশলে বেঁচে যায় স্ট্যান্ড রাজুরা। যা এখনো চলমান। 


অপরদিকে চিনারদির রাজু বাহিনীকে সেল্টার দেয়া শুরু করে খান মাসুদের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডালিম হায়দাররা। এই ২ বাহিনী বন্দরের উক্ত এলাকাগুলোকে একগুচ্ছ ভাবে নিয়ন্ত্রণে নিতে গিয়ে প্রায় সময় ঘটত মারামারি ও লুটপাট। 


বন্দরের আমিন, র‌্যালী, রুপালি এলাকাসহ নদীর পার তাদের কথা ছাড়া যেন গাছের পাতা নড়তো না। কেউ বাড়ির কাজ করলে মিষ্টির টাকা, তারপর আবার নিতে হবে ইট, বালু, পাথরসহ সকল মালামাল।  ক্ষমতাসীন দলের কারা নির্যাতিত নেতা খান মাসুদের ব্যানারে এত কিছু করলেও তাকে রাখা হত ঘুমের গড়ে। 


খান মাসুদের নাম ভাঙ্গিয়ে এত কিছু করে বর্তমানে প্রায় প্রতিজনই অর্থশালী বনে গেছেন।  ওই দন্দের রেশ প্রতিনিয়ত আরো বাড়তে থাকে। বড় ভাইদের স্বার্থ হাসিলে ৩ টি গ্রুপ হয়ে পড়ে। 


গত এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখে দুই রাজু বাহিনীর সাথে ৩ দফা মারামারি হয়। ওই দিন উভয় পক্ষের ডজন খানিক যুবক গুরুতর রক্তাক্ত জখম হয়েছে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের প্রায় অর্ধ ডজন মামলা হয়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে  এক মাস ২৫ দিন আগে রমজান মাসে বন্দর উপজেলার রূপালী এলাকায় মেরাজুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। 


সেই খুনের রেশ কাটতে না কাটতেই উপজেলার ঘাড়মোরা বাজারে ক্যাপ রোমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ‘খুনোখুনির’ এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে বন্দর। এতে পুরো বন্দর উপজেলা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বড় ভাইদের স্বার্থ হাসিল দ্বন্দ্ব একই স্ট্যাইলে ৩ টি লোমহর্ষক হত্যা কান্ডের ঘটনা ঘটে। 


ক্যাপ রোমান খুনের পর অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সঙ্গে জ্বালানি তেল ব্যবসার বিরোধ হওয়ায় সম্প্রতি ক্যাপ রোমান আরেকটি গ্রুপের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। এরপর থেকেই ক্যাপ রোমান এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। 


ব্লাক জনি, দয়াল, ডালিম, রমজান এক গ্রুপ শহরের ভাইজান খ্যাত এক রাজনৈতিক পরিবারোর সন্তানের নাম ব্যবহার শুরু করে।  আর নিহত ক্যাপ রোমান, জুয়েল আলাদা সিন্ডিকেড। পরবর্তীতে অনিক গ্রুপের সঙ্গে প্রভাব বিস্তার নিয়ে কয়েকবার সংঘর্ষ জড়ান। 


মূলতঃ অনিক বাহিনীকে শহরের একটি প্রভাবশালী পরিবার ও স্থানীয় একাধিক মামলার আসামি আকিব হাসান রাজু নিয়ন্ত্রণ করতেন। নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে গিয়ে খুন হয় ক্যাপ রোমান। ক্যাপ রোমান হত্যা কান্ডের ঘটনায় আসামী করা হয় ব্লাক জনির সেকেন্ড ইন কমান্ড দয়ালকে।


ওই ঘটনায় দয়াল, রোমান, ব্লাক জনি, ডালিম, রমজানরা এক সাথে বাহিনী নিয়ে ঘারমোরা ডুকলেও পিছন থেকে দয়াল, জনি, রজমান পিছু হটে। ক্যাপ রোমান একা হয়ে গেলে অনিক, রাসেলরা দাড়ালো অস্ত্র নিয়ে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে ছিল। 


তারা ক্যাপ রোমানকে পায়ে আঘাত করে রাস্তায় ফেলে এলোপাতারি কুপিয়ে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এজাহারনামীয় ১৩ নম্বর আসামি পারভেজ বন্দরে আকিব হাসান রাজুর প্রধান সহযোগী। 


অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, গেল ২০১৭ সালের মে মাসে বন্দর উপজেলার সাবদী বাজারে হাফেজ আনিছকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেই মামলায় এজাহারনামীয় ৫নং আসামি ছিলেন আকিব হাসান রাজু।  ২০২৩ সালের রমজান মাসে বন্দর রূপালীতে মেরাজুল ইসলাম খুনের মামলায়ও প্রধান আসামি আকিব হাসান রাজু।


সর্বশেষ (২৬ মে) উপজেলার ঘাড়মোরা বাজারে ক্যাপ রোমান খুনের আসামি হয়েছে তাঁরই প্রধান সহযোগী পারভেজ। তবে সাবদীতে হাফেজ আনিছ ও রূপালীতে মেরাজ হত্যা একই কায়দায় করা হয়েছে। দুটি হত্যার সঙ্গে আকিব হাসান রাজু জড়িত থাকলেও ক্যাপ রোমান হত্যায় তাঁর বাহিনীর দুই সদস্য অনিক ও পারভজ জড়িত ছিল বলে মামলায় উল্লেখ্য করা হয়।  


যদি ঘটনার দিন রাতে চুনাভুরা এলাকায় একটি খেলার অনুষ্ঠানে ছিলেন বলে ভিডিও টা সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইসবুক দেখা মিলেছে। । 


স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, বন্দরে উপজেলায় আলোচিত তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। এই হত্যাকাণ্ডের পিছনেও রয়েছে আকিব হাসান রাজু। তার বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা রয়েছে বন্দর থানায়। তিনি নিজের নামে বাহিনী গঠন করে এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।


আতংকের অপর নাম 'বন্দর' তিন খুনের নেপথ্যে 'বড় ভাই'রা' ভাইদের নিয়ে বেকায়দায় আছে পুলিশও
রাজনৈতিক প্রশয়ে বন্দরে একের পর এক ঘটছে খুনের ঘটনা। এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার চাঁদাবাজি-ধান্ধাবাজির পাশাপাশি মারামারি-খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়লেও কোনো সমস্যা হয় না তাদের। এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে গিয়েই একজনের লাশ ফেলছে আরেকজন।


অনুসন্ধানে দেখা গেছে অধিকাংশ খুনের নেপথ্যে আছে রাজনৈতিক “বড় ভাই”। তাদের নিজেদের প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক গ্রুপ তৈরি করে।  বড় ভাইয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে খুনের ঘটনাও। 

 

বন্দরে দুই মাসে আধিপত্য নিয়ে খুন হয়েছেন দুইজন। যারা খুন হয়েছেন তারাও রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের লোক ছিল। কয়েকটি খুনের ঘটনায় জড়িতরা ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে বড় ভাইরা। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় বড় ভাইদের নিয়ে বেকায়দায় আছে পুলিশও।


বন্দরে কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে আলোচিত হিসেবে পরিচিত চুইল্লা রাজু। এই বন্দরে র‌্যালি ও আমিন আবাসিক ও রূপালী এলাকায় রয়েছে তাদের ঘাটি। এসব জায়গায় সক্রিয় রয়েছে একটি গ্রুপ। এই গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন যুবলীগ নেতা খান মাসুদের সেকেন্ড ইন কমান্ড ডালিম হায়দার। চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত এ গ্রুপের সদস্যরা।


এদিকে এলাকাবাসী বলছে, বন্দরে মূলতই কিশোর অপরাধীদের নেতৃত্ব দেন প্রভাবশালী এক নেতা। তাদের বিরুদ্ধে এলাকার কেউ মুখ খুলে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। একনকি থানায় অভিযোগ দিতে গিয়ে পুলিশের উল্টো হয়রানির ভয়েও অনেকে নীরব থাকছে। খুনিরা ওই প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে দিনরাত এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায়।