
মহালয়া মানে দুর্গাপূজার শুরু। ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও মূলত আজ থেকেই দুর্গা মায়ের আগমন ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। মহালয়ার ছয় দিন পর মহাসপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তার পর দশমী অর্থাৎ শুভ বিজয়া। কথিত আছে, দশমীতে শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন।
হিন্দু ধর্মমতে, মহালয়ার দিনে দেব-দেবীকুল দুর্গাপূজার জন্য নিজেদের জাগ্রত করেন। শাস্ত্রীয় বিধান মতে, মহালয়ার দুটি পর্ব রয়েছেÑ একটি পিতৃপক্ষ, অন্যটি দেবীপক্ষ। অমাবস্যা তিথিতে পিতৃপক্ষের শেষ হয়, আর প্রতিপদ তিথিতে শুরু হয় দেবীপক্ষ।
আজ মহালয়া দিয়ে শুরু হচ্ছে সেই দেবীপক্ষ। এই দিন গঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীর তীরে প্রার্থনা করে ভক্তরা মৃত আত্মীয়স্বজন ও পূর্বপুরুষদের আত্মার মঙ্গল কামনা করেন। আজ ভোর থেকে সারাদেশে স্থায়ী-অস্থায়ী দুর্গা মণ্ডপগুলোতে চণ্ডীপাঠ ও পূজা অর্চনার মাধ্যমে দুর্গা দেবীকে আহ্বান করা হচ্ছে। এভাবেই আজ মর্ত্যলোকে, আবাহন ঘটবে দেবী দুর্গার।
কালিকাপুরাণে পঞ্চষষ্টিতমোহধ্যায় (৬৫তম) এ ২৯ ও ৩০ তম শ্লোকে আছে হে পরমেশানি দেবী ! আগমন করুন, আগমন করুন, এই স্থানে সান্নিধ্য স্থাপন করুন ; হে শারদে ! হে দুর্গে ! আপনি সগণ এবং সপরিকর হইয়া এই স্থানে আগমন করিয়া এই মদ্দত্ত পূজাভাগ গ্রহণ করুন ; আমার এই যজ্ঞ রক্ষা করুন, আপনাকে নমস্কার করি।
প্রকৃতপক্ষে পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের সূচনালগ্নকে মহালয়া নামে আখ্যায়িত করা হয়। তবে এই দিনটির তাৎপর্য একটু ভিন্ন। মহালয়া তিথিতে হিন্দু ধর্মালম্বীরা তাদের পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন, তাদের প্রতি তর্পণ অর্পণ করেন এবং তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন।
সনাতন ধর্মানুসারে, এই দিনে মূলত প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠানো হয়। প্রয়াত আত্মার এরূপ সমাবেশকে মহালয় বলা হয়। আর এই মহালয় থেকেই মহালয়ার উদ্ভব।
শ্রীশ্রীচন্ডীতে বলা হয়েছে- সেই জগজ্জননী মঙ্গলময়ী সর্বৈশ্বর্যশালিনী মহাশক্তিস্বরূপিণী এই জগতকে ধারণ করে রয়েছেন। শ্রীশ্রীচন্ডীতে আরও বলা হয়েছে, তিনি জগৎ-সৃষ্টির মূল কারিকা-শক্তি। তিনিই আবার পালন করেন এবং প্রলয়কালে তিনিই আবার সংহার করেন। তিনিই জগৎ-স্বরূপা।
জগতের সৃষ্টিকালে তিনি সৃষ্টিশক্তিরূপা। পালন-কালে স্থিতিশক্তিরূপা এবং প্রলয়কালে তিনি সংহারশক্তিরূপা। জগতের আদি থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে তাঁর ভূমিকা। সেজন্য তিনি আদি দেবতা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরেরও আরাধ্যা মাতৃস্বরূপা।
মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম আছে। সেগুলোর নাম হলোপ্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাকে তার পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যরে মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্য মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান।
পরবর্তী প্রজন্মেও একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মেও একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে চলে যান। এই কারণে, কেবল জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে।
ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র অকালে দুর্গা দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য। আসল দুর্গাপূজা হয় বসন্তকালে। আর সেই পূজাকে বলা হয় বাসন্তি পূজা। শ্রীরামচন্দ্র অকালে অর্থাৎ অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে শরতের দুর্গাপূজাকে অকাল-বোধনও বলা হয়।
সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে পূর্বপুরুষদের জন্য, সঙ্গে সমগ্র জীবজগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তর্পণ মানে খুশি করা। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে তর্পণ করেছিলেন।
সেই অনুসারে মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরুষদের স্মরণ করে, আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। মহাভারতে বলা হয়েছেÑ দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তার আত্মা স্বর্গে গমন করেন।
মহালয়ায় মানব সন্তানদের কল্যাণ প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে দেবীমাতা দুর্গা নিজগৃহে পদার্পণ করেন। যেন স্বহস্তে ও বীরদর্পে করে যান দুষ্টের দমন আর সৃষ্টের পালন। মন্দিরে মন্দিরে মাতৃশক্তির চেতনা সঞ্চারিত অগণিত পূজারী সন্তানগণের সম্মুখে পুষ্পে পুষ্পে সুসজ্জিত ও শোভামণ্ডিত হন সেই আদ্যাশক্তির মহামূর্তিÑ মা দুর্গা।
মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী এবং সবশেষে মহাবিজয়া দশমী। ওই দিন মা দুর্গা সকলকে সুখ-শান্তিময় জীবনের বরদান দিয়ে কৈলাস যাত্রা করেন। এভাবেই মহালয়া থেকে শুরু করে বিজয়া দশমীর এক উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার সমাপণ ঘটে।
লেখক: তারাপদ আচার্য্য, সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ