নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা-২০২৫ শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহিন। সাংবাদিক বিল্লাল হোসেন রবিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু সাউদ মাসুদ।
সভার শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন সংগঠনের সদস্য মনির হোসেন। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ২৪-এর আন্দোলন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ উসমান হাদি এবং স্বাধীন বাংলাদেশে নিহত সকল সাংবাদিকের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এরপর নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক একেএম মাহফুজুর রহমান তার সাংগঠনিক রিপোর্টে সভাপতি আবু সাউদ মাসুদের ওপর বিগত সময়ে সংঘটিত নির্যাতনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি জানান, সভাপতির ‘কলমকে থামিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে’ তার বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। পাশাপাশি গত দুই বছরে ইউনিয়নের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেন।

অর্থ সম্পাদক মোশতাক আহমেদ শাওন আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এ সময় নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যতকরী কমিটির সদস্যসহ সকল সদস্য বৃন্দ উপস্থিত ছিলেন এবং সকল সদস্যদের সমর্থন ও হাত তোলার মাধ্যমে উভয় রিপোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুর রহমান শাহিন স্পষ্ট ভাষায় বলেন, আপনাদের সভাপতি আবু সাউদ মাসুদ ভাই বলেছেন সাংবাদিকদের উপর হাত উঠলে সেই হাত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হবে।
আমি এর সাথে যুক্ত করে বলতে চাই “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যদি আর একটি মামলাও হয়, কিংবা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যদি একটি ‘টু’ শব্দও উচ্চারিত হয়—নিবন্ধিত এই নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের পাশে আমরা দাঁড়াব। প্রয়োজনে দেখবো প্রশাসনের এসপি-ডিসি কীভাবে এখানে থাকে।

তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শক্তি দেশের মানুষের কণ্ঠরোধ করতে চাইলেও সাংবাদিকদের কণ্ঠস্বর বন্ধ করতে পারেনি। নতুন বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ভেবেছিলাম ৫ আগস্টের পর আর আন্দোলন করতে হবে না, কিন্তু বাস্তবতা হলো—এখনো আমাদের আন্দোলনে থাকতে হচ্ছে।”
তথ্য উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সদ্য পদত্যাগকারী তথ্য উপদেষ্টার পেছনের চরিত্র আরও ভয়াবহ। ফ্যাসিস্টদের পত্রিকায় দুইটি সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়েছে—এটা উদ্বেগজনক।” নতুন তথ্য উপদেষ্টার কাছে সাংবাদিকদের দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, “মিডিয়াকে আটকে রাখা বা অন্ধকারে রাখার কোনো সুযোগ নেই।”
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি দুটি দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেন সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে, পেশাগত দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নকে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি প্রত্যাশা করেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বিএফইউজে সভাপতি বলেন, “২৪-এর আন্দোলনে যে আপোষ করা হয়নি, ক্ষমতার স্বার্থে যদি এখন আপোষ করা হয়, আধিপত্যবাদকে সুযোগ দেওয়া হয়—তা হবে দেশবাসীর সঙ্গে চরম প্রতারণা। দেশবাসী তা ক্ষমা করবে না।”
তিনি আরও বলেন, দুই হাজার ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ও হাজার হাজার আহতের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রত্যাশা রাজনৈতিক বিভেদের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলের প্রতি তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকার আহ্বান জানান।
তারেক রহমানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার যে প্রত্যাশা তারেক রহমান ব্যক্ত করেছেন, আমরাও সেটাই চাই।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ খন্দকার আলমগীর হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সাংবাদিকরা এখন আমাদের শাখা করার জন্য জানাচ্ছে, কিন্তু আমরা করছিনা, অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করছি।

নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়ন এমন নয়, এটি ০৫ আগস্টের পর হয়নি, বরং যখন ক্রান্তিকাল ছিলো, তখন তারা আমাদের পাশে থেকে আধিপত্য বাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, লড়াইয়ের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের জন্ম হয়েছে। তিনি বলেন, “এখানকার সদস্যরা সবাই ভালো, স্ট্যান্ডার্ড মেইন টেইন করে, ভালো ভালো মিডিয়ায় কাজ করেন এটাই এই সংগঠনের শক্তি।”
নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক গোলাম সারোয়ার সাঈদ বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও নতুন বাংলাদেশ গঠনে সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান নতুন বাংলাদেশ যেন নতুন ফ্যাসিবাদের হাতে না পড়ে, সে বিষয়ে সতর্ক ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি রাজউকের পরিকল্পনা, নিয়মতান্ত্রিক অনিয়ম, রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়ন, সিটি করপোরেশনের জবাবদিহি এবং ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন। তিনি জানান, দেড় বছরে নারায়ণগঞ্জে ১৪২টি ঘটনায় ব্যবসা পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি।
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)’র দপ্তর সম্পাদক আবু বক্কর বলেন, ফ্যাসিস্ট আমলে এমন মুক্ত পরিবেশে কথা বলার সুযোগ ছিল না। তিনি জুলাই যোদ্ধা ও আহত-নিহতদের স্মরণ করেন এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, নিরপেক্ষভাবে তথ্য তুলে ধরতে না পারাই ফ্যাসিবাদের উত্থানের অন্যতম কারণ।

তিনি আরও বলেন, কোনো গণমাধ্যমে হামলা হোক, সেটা আমরা চাই না। তবে, প্রথম আলো ও ডেইল স্টারের অতীত ভুমিকা খুব একটা সুখকর নয়। অতীতে যখন বিভিন্ন মিডিয়ার উপর হামলা হতো তখন তাদের ভুমিকা ছিলো নীরব।
অতীতে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামী টিভি, চ্যানেল ওয়ান, নয়া দিগন্ত পত্রিকা, আমার দেশ পত্রিকা অফিসগুলোতে হামলা করা হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় তখন প্রথম আলো-ডেইলী স্টার কোনো প্রতিবাদ করে নি। এখন কেন এতো হৈ চৈ। দেশের সবচেয়ে প্রবীণ সম্পাদক নয়া দিগন্তের সম্পাদক আসাদ ভাইয়ের উপর নির্যাতন করা হয়, তখন তারা কিছু বলে নি।
শ্রম অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ শাখার উপ-পরিচালক ইয়াসমিন আক্তার বলেন, একটি ইউনিয়নকে সচল রাখতে সাধারণ সভা গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকদের অপসাংবাদিকতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সাংবাদিক ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন পাওয়া সহজ নয় এবং শ্রম অধিদপ্তর সবসময় সহযোগিতায় প্রস্তুত।
সভাপতির বক্তব্যে আবু সাউদ মাসুদও প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের উপর হামলার নিন্দা জানান, কিন্তু তাদের অতীত ভুমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ভাইকে যখন হামলা করে রক্তাত্ব করা হলো, তখন প্রথম আলো ও ডেইলি কোনো পদক্ষেপ তো নেই নাই, এমনকি সেই নিউজটি পর্যন্ত প্রকাশিত করে নি।
তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, সাংবাদিকদের উপর হাত উঠলে সেই হাত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হবে। তবে, সাংবাদিকদের অপসাংবাদিকতা পরিহার করে সঠিক পথে সাংবাদিকতা করারও আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন এনইউজে সদস্য ফররুখ খসরু, সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি, আবু সাউদ তানভীর, নাসির উদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম হানিফসহ আরও অনেকে।
সভা শেষে উম্মুক্ত আলোচনায় সদস্যদের মতামত গ্রহণ করা হয়। বক্তারা ঐক্যবদ্ধ থেকে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষা, জনমত গঠন এবং নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।


































