নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

সোমবার,

০২ ডিসেম্বর ২০২৪

মজলুম জননেতাকে তৃণমুলের  মজলুমদের ‘লাল কার্ড’ 

কামাল উদ্দিন সুমন:

প্রকাশিত:২০:৪৬, ৯ জানুয়ারি ২০২৪

মজলুম জননেতাকে তৃণমুলের  মজলুমদের ‘লাল কার্ড’ 

দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক । তার চলাফেরা ও সম্পর্ক ঠেলাগাড়ি চালক, রিকশাচালকদের সঙ্গে।নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে যারা পতিতাদের নির্যাতন করেছে সেই নির্যাতিতদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি তিনি । বোমা হামলা মামলার আসামী হয়েছেন, মামলা আসামী হয়ে একসময় নারায়ণগঞ্জ ছাড়া হয়েছেন।  রাজনৈতিক মামলার আসামী হয়ে জেলে খেটেছেন। গরীব দু:খী মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। তার প্রতি জুলুম হওয়ার কারনে একসময় তাকে উপাধি দেয়া হয়েছে মজলুম জননেতা। তিনি হলেন এ্যাড.তৈমুর আলম খন্দকার । তবে সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বার্চনে তৃনমূলের মজলুম মানুষ তাকে ‘লাল কার্ড’ দেখিয়েছেন । 


রাজনৈতিক খোলস পরিবর্তন করে (কারো ভাষ্য: আওয়ামীলীগের সাথে আঁতাত করে) দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ আসন রুপগঞ্জ থেকে অংশ নেন বিএনপি  থেকে বের হয়ে গঠিত তৃনমূলের বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার। অনেকে মনে করেছিলেন তৈমুর আলম খন্দকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তার দল তৃনমুল বিএনপি আগামী সংসদ সংসদে বিরোধী দলের ভুমিকা পালন করবে। অতিমাত্রায় লোভে পড়া তৃনমূল বিএনপির নেতাদেরকে মাঠের মানুষ অনেকটা ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। তার অনন্য দৃষ্টান্ত হলো  তৈমুর আলম খন্দকার। তার আম-ছালা দুটোই গেছে। নির্বাচনে তিনি জামানত হারিয়েছেন। এই আসনে মোট ভোট পড়েছে দুই লাখ ১২ হাজার ৬২৪টি। তৈমুর ভোট পেয়েছেন মাত্র ৩১৯০। তৈমুর আলম খন্দকারের এমন হার শুধু লজ্জারই নয় । তৃনমুলের মানুষ তাকে লাল কার্ড দেখিছেন। তারা আবারো প্রমান করে দিয়েছেন খোলস পাল্টানো মানুষকে কেউই গ্রহণ করেন না।

 
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে সর্বপ্রথম সবচেয়ে বেশি সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপির প্রয়াত সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী। তিনি ৪ বার সংসদ সদস্য ছিলেন। এ আসন বিএনপি অধ্যুষ্যিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে কালের পরিক্রমায় এ আসন দখলে যায় আওয়ামীলীগের । সর্বশেষ ১২তম সংসদ সদস্য নির্বাচনে গোলাম দস্তগীর গাজী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপি আসন থেকে সর্বশেষ অংশ নেয় ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে । তখন গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রতিদ্বন্ধি ছিলেন বিএনপির কাজী মনিরুজ্জামান। সেই সময়ই বিএনপির প্রার্থী ভোট পায় ৯৫হাজার ৭৬৩। এবারের নির্বাচনের বিএনপির কোন প্রার্থী ছিলনা । তবে ভোটার বেড়েছে আরো বেশি। বিএনপি থেকে বের হয়ে যাওয়া তৈমুরের প্রতি এসব ভোটাররা যদি সদয় হতেন তাহলে অত্যন্ত তিনি  জামানত হারাতেন না। 


নির্বাচনের আগে তৈমুর আলম খন্দকার বলেছিলেন , ‘জনগণ এবার তাদের ভোট দেয়ার মতো একটা প্রার্থী পেয়েছে। আমি আশাকরি তারা ভোট দিতে আসবে। অনেকে বলে বিএনপির সঙ্গে আমার এই অবস্থা কেন? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ড. বি চৌধুরী, কর্নেল অলি তাদের নিয়ে দলটি গঠন করেন। তারা যে কারণে দলে থাকতে পারে নাই আমিও সেই কারণে পারি নাই।’


তার দাবী ছিল, ‘বাংলাদেশে আমার মতো একটা সৎ মানুষ কেউ দেখাইতে পারবো না। আমি নগণ্য প্রার্থী। মাওলানা ভাসানীর নামে আমাকে সবাই মজলুম জননেতা বলেন। আমার ৩টি বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি আছে। আমার । নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্কুল কলেজ আমি নিজে প্রতিষ্ঠা করেছি।কেউ বলতে পারবে না আমি ১০টা টাকা নিয়েছি। 


তবে ভোটের পর তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সাজানো নির্বাচন হয়েছে । তিনি বলেন, তারা আগে থেকেই ভোট দিয়ে বাক্স ভরে রেখেছে। সরকারি দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষের মধ্যে সাজানো নির্বাচন হয়েছে। আর কাউকে সুযোগ দেয়নি। তারা যে আগেই ব্যালটে সিল মেরে রেখেছিল, এটা ফেসবুকেও আসতেছে। আমার পরাজয়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, আমি কোনো সুবিধা নেইনি। নিলে সরকারের বিরুদ্ধে যে কথা বলি এটা বলতাম না। সুবিধা নিলে তো আর ফেল করতাম না।


দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি তৈমূর আলমকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এরপর দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তিনি ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়েই মহাসচিবের দায়িত্ব পান।


তৈমূর আলম প্রথম নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে শোনা গেলেও পরে নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে মনোনয়ন কেনেন। পরে নির্বাচনী প্রচারণার বিভিন্ন সময় তিনি বলেন, তৃণমূল বিএনপি সংসদে বিরোধী দল হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায় তিনি কিংবা তার দলের কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই আসতে পারেননি।


নিজের ভরাডুবি সম্পর্কে তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠ হয়নি। প্রত্যেক রাতে টাকা বিলি হয়েছে। টাকা দিয়ে ভোট কিনেছে। আমরা নির্বাচন কমিশনে টাকা বিলি সম্পর্কে অভিযোগ করেছি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সবকিছু মিলিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যাকে বলে সেটা হয়নি।


তিনি বলেন, মানুষের বিবেক বিক্রি হয়ে গেছে। কিছু মানুষ আছে যারা অল্প মূল্যে বিক্রি হয়। ২-৪ হাজার টাকায় ভোট বিক্রি করে দেয়। আমাদের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ ভোট বিক্রি করে। আর ভোট বিক্রির সুবিধা নেয় এ দেশের পুঁজিবাদি সমাজ। এরপর তারা নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসন করে। এটা মানুষের বিবেকের বিষয়। বিবেক তো জাগ্রত হয় না। আমি যে ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধে বললাম, যাদের জন্য বললাম তারা আমাকে ভোট দেয়নি।


২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে আওয়ামীলীগের ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামেন তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি এড.তৈমুর আলম। সেবার জনমত তার পক্ষে থাকলেও দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচনের আগের রাতে তাঁকে নির্বাচন থেকে সরে যেতে হয়।  একযুগ পর ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামীলীগের জনপ্রিয় মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তৈমুর আলমকে দলের সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।


প্রসঙ্গ, ১৯৯৬ সালে তৈমুর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও শামীম ওসমানের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। পরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। সে সময় চাষাঢ়ায় অবস্থিত শহীদ জিয়া হলের নাম পরিবর্তনের তীব্র বিরোধিতা করে আলোচনায় আসেন তৈমুর। সেই বছরই নিষ্ক্রিয় আবুল কালামকে সরিয়ে শহর বিএনপির সভাপতি পদ দেওয়া হয় তৈমুর আলম খন্দকারকে। 
বিএনপিতে যোগদানের পর শামীম ওসমানের সঙ্গে বিরোধ আরও জোরালো হয়। শহরের শায়েস্তা খান সড়কে তৈমুরের চেম্বার থাকলেও শামীম ওসমানের সঙ্গে বিরোধের কারণে ১৯৯৭ সালে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে ঢাকায় আইন পেশায় যুক্ত হন। ওই সময় একটি রাজনৈতিক মামলায় হাইকোর্ট থেকে গ্রেফতার হোন। ২০০১ সালের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার ঘটনায় তৈমুর আলমকে প্রধান আসামি করা হয়। এরপর থেকে আলোচনায় উঠে আসেন তৈমুর। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর তৈমুর আলম খন্দকার বি আরটিসির চেয়ারম্যান হন। এর আগে তিনি ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। ২০০৩ সালে তৈমুরকে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পর যৌথ বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়, যার মধ্যে একটি মামলায় ১২ বছরের জেল হয়। পরে অবশ্য ২০০৯ সালের মে মাসে তিনি মুক্তি পান। 


ওই বছরের জুন মাসে তৈমুরকে আহ্বায়ক করে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। বছরের শেষ দিকে ২৫ নভেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে তৈমুর হন জেলা বিএনপির সভাপতি। একই সঙ্গে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জেলার ১৮ দলীয় ঐক্যজোটের আহ্বায়ক করা হয়। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন তৈমুর। বিএনপি প্রথম দিকে তাঁকে সমর্থন দিলেও ভোটের মাত্র ৭ ঘণ্টা আগে দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে তিনি নির্বাচন থেকে সরে আসেন তিনি।
এড.তৈমুর আলম খন্দকার এক সময় নাসিক মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভীর প্রয়াত পিতা এবং  নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহম্মদ চুনকার অন্যতম সহচর ছিলেন। দীর্ঘদিন আলী আহম্মদ চুনকার সঙ্গে থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন। 


তৈমুর আলম খন্দকারের রাজনৈতিক জীবনের শেষ দিকে এসে অতিমাত্রায় যে লোভে পড়েছেন। সেটা মানুষের কাছে অনুমেয়। গরীব দু:খী মানুষের তৈমুর আর তৃনমূল বিএনপি তৈমুরকে মানুষ আলাদা করে দেখার সময় শুরু করেছে। 

 

কামাল উদ্দিন সুমন
সিনিয়র সাংবাদিক 
সাবেক প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক 
ঢাকা রিপোর্টার্স  ইউনিটি 

সম্পর্কিত বিষয়: