
শাকিল চৌধুরী শুভ। এসবি মার্টের মালিক। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার শিবু মার্কেট এলাকায় বসবাস। ৩১ মে শনিবার রাতে সিলেটের জাফলং থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। রাত আড়াইটায় তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় নামেন। এতো রাতে কোন বাস না পেয়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে ব্যাটারি চালিত একটি অটোতে ওঠেন শুভ।
অটোতে চালক ও একটি বাচ্চাসহ ৮ জন। অটোটি ভুইগড় বাসস্ট্যান্ডের কিছুটা আগে আসতেই রাস্তার পাশ থেকে কিছু বুঝে উঠার আগেই এক যুবক আস্ত একটা ইট অটো চালকের মাথা বরাবর নিক্ষেপ করে। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারের মাথা ও মুখের চোয়াল ফেটে যায় এবং জ্ঞান হারিয়ে সে গাড়ির স্টেয়ারিংয়ের উপর পড়ে।
শুভ চালকের ডানপাশে সামনের সিটে বসা ছিল। মুহুর্তেই অটোর স্টেয়ারিং ধরে ফেলে এবং অটোটি কন্ট্রোলে আনার চেষ্টা করে। এ সময় সে দেখে পাশ থেকে ৭ থেকে ৮ জন যুবক ছেলে চাপাতি ও রড নিয়ে বের হচ্ছে। শুভ বুঝে যায় ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু অটোর স্টেয়ারিংয়ের উপর চালক আহত হয়ে পড়ে থাকায় কোনভাবেই অটোটি কন্ট্রোল করতে পারছিল না শুভ।
পরে উপস্থিত বুদ্ধিতে রানিং অটো থেকে সে লাফ দেয় এবং জীবনের যত শক্তি আছে প্রাণ রক্ষার্থে দৌড়াতে থাকে। কাঁধে ট্যুরের ভারি ব্যাগ থাকায় দৌড়াতে ভীষন কস্ট হচ্ছিল তার। পায়ের স্যান্ডেল ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রানপনে ছুটতে থাকে শুভ।
এরই মাঝে কোনোমতে পিছনে এক পলক তাকিয়ে দেখে একজন যাত্রীকে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে। ভীতসন্তস্থ শুভ আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে দৌড়াতে থাকে। এসময় তা কানে আসে পেছন থেকে তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে ‘ওইটারে ধর’।
শুভ’র পেছনেই পিচ্চি যাত্রীটাসহ আরেকজন যাত্রী দৌড়াচ্ছিলো। এক পর্যায়ে একটা গার্মেন্টস দেখে নিচে বসে থাকা নাইট গার্ডকে শুভ বলে, ভাই বাঁচান, ডাকাতি হচ্ছে। নাইট গার্ড বললো ‘ভাই আমার কাছে থাইমেন না, আপনি পালান, ওরা আমাকে মানবে না’।
ঠিক তখন একটা সিএনজি ফেরেশতার মতো শুভ’র সামনে ব্রেক করে বলে ভাই জলদি উঠেন। পরে ভুইগড় বাসস্ট্যান্ডে সিএনজি থেকে নেমে পড়ে শুভ অনেক মানুষজন দেখে। একটি চায়ের দোকানে গিয়ে শুভ দোকানীকে বলে মামা আমাদের বাঁচান। দোকানদার শুভদের বসতে বললেন।
কিছুক্ষণ পরই শুভ দেখে সেই ডাকাত দলের দুইজন বাইকে করে এসে তার সামনে ব্রেক করে। তখন শুভ আশে পাশের মানুষকে বলে ভাই ওরাই ডাকাতি করছে। কিন্তু সবাই শুভকে থামিয়ে দিলো। শুভ বুঝতে পারে এদের বেশ প্রভাব এখানে। সবাই এই দলকে চিনে কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলেনা।
এই গ্রুপের নাম হুন্ডা পাটি। প্রায় প্রতিদিনই এরা রাতের বেলা এখানে এই কাজ করে। শুভ চুপ করে রইলো। কারণ তখন সে অসহায়। আরো কিছুক্ষণ পর অটোওয়ালা ও দুইজন আহত যাত্রী আসলো। অটোওয়ালার খুব বাজে অবস্থা। উপরের ও নিচের ঠোঁট দুই ভাগ হয়ে ঝুলছে। দাঁতের পাটি ভেঙে গেছে।
আরেক যাত্রীর হাতে একটা কোপ লেগেছে, আরেকজনের পিঠে ও হাতে তিনটা। শুভ বুঝতে পারলো এখানেও সে নিরাপদ নয়। কারন ডাকাত দলের লোক এখানেও আছে। যেই সিএনজিতে এসেছিল সেটাতেই লাফিয়ে উঠে শুভ। এবং বলে মামা টান দেন। সিএনজি চালক কোনো কথা না বলে একটানে শুভকে তার বাসার সামনে নিয়ে যায়। এলাকায় ফিরে শুভ’র মনে হলো হয়তো সে নতুন একটা জীবন পেয়েছে।
কিন্তু প্রশাসনের কাছে শুভ’র প্রশ্ন? এই যে প্রতিদিন এখানে খুন হচ্ছে এটা তাদের অজানা? না এটা অজানা নয়। পুরো নারায়নগঞ্জবাসী জানে এখানে এটা প্রতিদিনই হচ্ছে বলা যায়। তবু প্রশাসন নির্বিকার।
পরদিন শুভ তার ফেসবুক আইডিতে পুরো ঘটনাটি লিখে পোস্ট করেন। সেখানে শেষ লাইনে সে লিখেছে ‘সত্যি বলছি ভাই, অবৈধ পথে বিদেশে গিয়ে রোহিঙ্গা হিসেবে থাকাও ভালো, তবু জীবনের কিছুটা নিরাপত্তা পাওয়া যায় কিন্তু এই দেশে জীবনের নূন্যতম নিরাপত্তাও পাবেন না’।
শাকিল আহমেদ শুভ জুলাইয়ের একজন সক্রীয় যোদ্ধা। তার পোস্ট দেখে নড়ে চড়ে বসে সহকর্মীরা। এনসিপির নারায়ণগঞ্জের প্রতিনিধি আব্দুর রহমান গাফ্ফারী যোগাযোগ করে শুভ’র সাথে।
বুধবার (৪ জুন) আব্দুর রহমান গাফ্ফারী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের কমরেড আমিনুল ইসলামসহ শুভ চলে যায় নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। পুলিশ সুপারকে বিষয়টি অবহিত করে তারা যায় ফতুল্লা মডেল থানায়। থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কে পুরো ঘটনাটি অবহিত করে তারা চলে আসে।
বুধবার দুপুরে শুভ তার ফেসবুক আইডিতে আরেকটি পোস্ট দিয়ে আক্ষেপ করে লিখেছে‘ এখানে একটি মূখ্য বিষয় হলো সমস্যা শুধু শোনা নয়, সেটা সমাধানের চেষ্টায় কাজ করছে এই তারুন্যের দল। আমার সাথে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা বহু রাজনৈতিক নেতার কানেও গিয়েছিলো তারা কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।
সমস্যার সমাধান হোক বা না হোক তাদের সমাজ বদলানোর এই প্রচেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখন গর্ব করে বলতে পারি জুলাই আন্দোলনে আমরা সবাই ছাত্রজনতার পাশে দাড়িয়ে ভুল কিছু করিনি। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা এদেকে নিয়েই দেখতে পারি। ধন্যবাদ এই তরুণ নেতাদের। আপনাদের হাত ধরে বাংলাদেশকে পরিবর্তনের স্বপ্ন আমরা এবার দেখতেই পারি।
এদিকে এনসিপির আব্দুর রহমান গাফ্ফারী জানান, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি পুলিশের সহযোগিতায় তদন্ত করে জানতে পারলাম যে রাত ১২ টার পর যে বাইকাররা হাট থেকে গরু বেপারীদের রিসিভ করতে যায় তারাই এরকম ঘটনা ঘটায়। তাই পুলিশকে অনুরোধ করে এসেছিলাম প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আর রাতে টহল বাড়াতে।