
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়ন একটি গণবসতিপূর্ণ এলাকা। শিল্পসম্মৃদ এই ইউনিয়নে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখের উপরে। যা একটি সংসদীয় আসনের ভোটার সংখ্যার সমান। ফলে স্থানীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জনপদ। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের প্রভাবশালী বতর্মান সাংসদ শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকার একটি ইউনিয়ন হচ্ছে এই কুতুবপুর। ২০০২ সালের নির্বাচনে শামীম ওসমানকে পরাজিত করে বিএনপির গিয়াস উদ্দিন এই আসনে এমপি নির্বাচিত হন। গিয়াস উদ্দিনের বিজয়ে ভুমিকা রাখে কুতুবপুর ইউনিয়নের বিশাল ভোট ব্যাংক। ফলে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি দুই দলই এই জনপদে নিজেদের অবস্থান মজবুত রাখতে চায়। ফলে বিএনপির দীর্ঘদিনের কান্ডারী ও কুতুবপুর ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুকে দলে ভিড়ায় শামীম ওসমান। সাপোর্ট দেয় এখানকার আওয়ামীলীগ নেতারা। এতে করে ২০২১ সালের ১১ নভেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির সেন্টু নৌকা প্রতীক নিয়ে বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় চেয়ারম্যান হয়। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু সম্প্রতি সেন্টুর এক বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয় আওয়ামীলীগ নেতারা। সেন্টু বলেন, মাদক ব্যবসায়ি ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তিনি রাজনীতি করবেন না। অন্যদিকে আওয়ামীলীগ নেতারা বলেন, সেন্টু আওয়ামীলীগের যোগ দিলেও সে বিএনপির সঙ্গে আতাত রেখে চলছে। আওয়ামীলীগের কোন কর্মসূচিতে থাকে দেখা যায় না। এতে করে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে এখাকার আওয়ামীলীগ ও নব্য আওয়ামীলীগ। চলছে একে অপরের প্রতি বিষদাগার এবং পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বিবৃতি। এ নিয়ে চরম অস্বস্থি দেখা দিয়েছে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের মাঝে।
সুত্রমতে, দীর্ঘ সময় কুতুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিএনপি সমর্থিত মনিরুল আলম সেন্টু। ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে ফতুল্লা থানা যুবদলের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তৃণমূলের নেতা হিসেবে তার নজরে আসেন সেন্টু। ২০০৩ সালে ফতুল্লা থানা বিএনপির কাউন্সিলে গিয়াস উদ্দিনের আর্শিবাদে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত সেন্টু। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও কুতুবপুর ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মনিরুল আলম সেন্টু। ওই নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। অথচ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে নাশকতার একটি ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল ও গৃহীত হওয়ায় ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মনিরুল আলম সেন্টুকে তার পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরে এমপি শামীম ওসমানের সঙ্গে সখ্যতায় সেন্টুর সেই সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
এদিকে ২০১৪ সালে শামীম ওসমান সংসদ সদস্য হবার পর থেকে সেন্টু তার অনুগত হয়ে যান। এমপি শামীম ওসমানকে ‘পীর’ আখ্যায়িত করে বক্তব্য রাখেন। এবং ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক না নিয়ে স্বতন্ত্র প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন মনিরুল আলম সেন্টু। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ফতুল্লা থানা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মনিরুল আলম সেন্টুকে বিএনপি’র প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করে। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল আলম সেন্টু ৪২ হাজার ৯০৩ ভোট পেয়ে আবারো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি নৌকা প্রতীকের প্রার্থী গোলাম রসুল শিকদার পান মাত্র ১০ হাজার ৯৮৭ ভোট। সারাদেশে যেখানে নৌকার জয়জয়াকার ছিল সেখানে শামীম ওসমানের নির্বাচনী আসনে কুতুবপুরের চিত্র ছিল উল্টো।
এদিকে সেন্টুর সঙ্গে যোগসাজশে নৌকা ডুবালেও বছর না ঘুরতেই মনিরুল আলম সেন্টুর সঙ্গে বিরোধ বেধে যায় কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মানিক চাঁনসহ অন্যান্য আওয়ামীলীগ নেতাদের। বিশেষ করে আওয়ামীলীগ নেতাদের ভিজিএফ কার্ড না দেয়ায় বিরোধের সূত্রপাত। যে কারণে সেন্টু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের জুন মাসের শেষ দিকে বিক্ষোভ মিছিল করেন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী ও তাদের সমর্থকরা। ভিজিএফ কার্ড বিতরণ নিয়ে অনিয়মের প্রতিবাদে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয়া কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন তখন বলেছিলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে আনারস প্রতীকের প্রার্থী চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুর পক্ষে যারা কাজ করেছে তাদেরকেই এবার ভিজিএফ কার্ড প্রদান করেছেন সেন্টু। অপরদিকে যারা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন তাদেরকে এবার ভিজিএফ কার্ড দেননি সেন্টু। তিনি ভিজিএফ কার্ড নিয়ে রাজনীতি করেছেন। বিষয়টি আমি থানা ও জেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দদের জানিয়েছি। তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া না হলে আরো কঠোর আন্দোলন করা হবে।
তবে চয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু সাংবাদিকদের বলেন, কার্ড বিতরণের অনিয়ম কিছুই হয়নি। যারা বিক্ষোভ করেছে তারা মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসায়ী জসিমকে কার্ড দেইনি বলে আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ওদের সৎ সাহস থাকলে আমার কাছে আসতো। ওরা ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তুলে খায়। আমিতো ১৫ বছর ধরে চেয়ারম্যানগিরি করি। আমি ওদেরকে ভালমতোই চিনি। এরপর জল অনেকটা গড়ায়।
সবশেষ আওয়ামীলীগের বেশ কয়েকজন প্রার্থী থাকার পরও নাটকীয়ভাবে ২০২১ সালের ১১ নভেম্বরের ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়ে যান সেন্টু। এবং বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিন হন। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক বিএনপি নেতার হাতে তুলে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেলেও অনেকটা মুখ বুঝেই সহ্য করতে হয়েছিল অনেককেই।
চলতি বছরের ২৩ জুন ফতুল্লার পাগলা বাজার বহুমুখী ব্যবসায়ী সমিতির ২৫তম বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমপি শামীম ওসমান চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সেন্টু আগে বিএনপি করতো, এখন আওয়ামী লীগ করে। এটি তার মাথায় রাখতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দিয়েছেন। সেন্টু নিজে আওয়ামী লীগ করবে আর তার লোকেরা বিএনপি করবে, এটা হবে না। সেন্টুকে বলবো-সব নিয়ে আসুন আওয়ামী লীগে, একসঙ্গে কাজ করি।'
এদিকে ফতুল্লার কুতুবপুরের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি গ্রæপের সঙ্গে দেখা দেয় বিরোধ। তাঁরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বিষয়টি। ২০১৬ সালে নৌকা ডুবানোর খেসারত যে তাদের এমনভাবে দিতে হবে সেটা তারা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেননি।
ওদিকে শামীম ওসমানের জনসমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে ১২ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের ব্যানারে প্রস্তুতি সভা করা হয়। সেখানে এমপি শামীম ওসমান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। প্রস্তুতি সভায় বক্তব্য শেষে চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুকে জয় বাংলার শ্লোগান দিতে বলেন শামীম ওসমান। তখন সেন্টু চেয়ারম্যান বলেন, আমি কোন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের সঙ্গে বসবো না, এতে যদি আমাকে রাজনীতি ছেড়ে দিতে হয় আমি দিবো। আপনি (শামীম ওসমান) যদি বলেন আমি চেয়ারম্যানিও ছেড়ে দিব। তার পরও কোন সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমি আপোষ করবো না। কারণ আমার পারিবারিক একটি ঐতিহ্য আছে। আমি মাদক তো দূরের কথা একটি টাকা চাঁদাবাজী করি নাই। কিন্তু যে এক দুইজনের কারণে এলাকার হাজার হাজার মানুষ অশান্তি করবে তাদের সঙ্গে আমি চলতে পারবো না। আমি যখন বিএনপি করি তখন বিএনপির যারা অপরাধ করতো তাদের দৌড়ের উপর রাখতাম। ওই সময়ে শামীম ওসমান মাইক হাতে তুলে নিয়ে বলেন, আমার পরিবারের কেউও যদি মাদক, চাঁদাবাজী করে কোন ছাড় দেওয়া হবে না। আমি তোমার সঙ্গে আছি।
ওই বক্তব্যে সেন্টু কারো নাম উল্লেখ না করলেও এর প্রতিক্রিয়া এসেছে সেখানকার যুবলীগ নেতা মির হোসেন মিরুর কাছ থেকে। যার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজীসহ অসংখ্য মামলা ও অভিযোগ রয়েছে। সমাবেশের পর সেন্টুর বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলনেরও ঘোষণা দেন মিরু। এর দুইদিন পর ১৪ সেপ্টেম্বর কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রস্তুতি সভায় ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি হাজী জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মো. নাজিম উদ্দীন আহম্মেদ। সেখানে মীররু বলেন, যারা আমার মা বোনকে পিটিয়েছে, আমার ভাইকে শরীরের কোন জায়গা বাদ নাই যে পিটায় নাই, তারাই নাকি ভালো আর আমি সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী হয়ে গেলাম।
কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেন্টুকে উদ্দেশ্যে করে মীরু বলেন, যখন নৌকার নির্বাচন করেছেন তখন চরমোনাই এর প্রার্থীর মনোনয়ন কে ছিনিয়ে এনেছিল? বাসদের মনোনয়ন কে ছিনিয়ে এনেছিল? ও তখন আমি ভালো ছিলাম, এখন খারাপ হয়ে গেছি। আমাকে মারবেন মারেন আমি মরলে আপনি হবেন এক নাম্বার আসামী। ১৬ তারিখ জনসভার পর আপনার বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলন করবো। আমাদের সবাইকে অপমান করেছেন কারা আওয়ামী লীগের ভিতরে মাদক ব্যবসায়ী তাকে দেখাতে হবে না হলে আমরা এর জবাব চাইবো শামীম ওসমানের কাছে। তিনি কোন সমাধান না দিলে আমরা আওয়ামীলীগ থেকে পদত্যাগ করবো।
এদিকে সেন্টুর ওই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে গোটা কুতুবপুরের আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরাই। বিশেষ করে কর্মী সমাবেশে সেন্টুর এ ধরনের বক্তব্য আশা করেননি কেউই। বিগত দিনেও সেন্টুর পক্ষ নিয়ে নৌকা ডুবালেও পরবর্তীতে আওয়ামীলীগের অনেক নেতাকেই নিগৃহীত হতে হয়েছে। এখন সেন্টুর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সেই ছাই চাপা আগুনে যেন ঘি ঢেলেছে। যে কারণে এখন সেন্টুর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে শীর্ষ নেতাদের কাছে নালিশ নিয়ে ধর্না দিচ্ছেন কুতুবপুর আওয়ামীলীগ নেতাদের অনেকেই। শেষ পর্যন্ত কুতুবপুরের আওয়ামীলীগের গৃহবিবাধ কোথায় গিয়ে শেষ হয় তা দেখার অপেক্ষায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা।