ঘড়িতে তখন রাত দশটা বেজে দশ মিনিট। নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাড়ার প্রান্তিক পেট্রোল পাম্পের সামনে শুয়ে আছে তিন বছরের শিশু ইয়াসিন। গায়ে সবুজ রঙের ওড়না জড়ানো। মাথার পাশে টাকা ভর্তি প্লাস্টিকের বক্স। একটু কাছে যেতেই দেখা যায় শিশুটি ঘুমিয়ে আছে। আশে পাশে খোঁজ নিলেও পাওয়া যায়না শিশুটির স্বজন।
পাশে থাকা হকার আল আমিন বলেন, কাউকে পাইবেন না, ওর বড় বোন আছে, টাকা তুলতাছে। এশার আযানের পর এখানে শোয়ায় গেছে। ৩ ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে, এখনো আসে নাই। তিনি জানান, প্রতিদিন একই পন্থায় টাকা তুলে ইয়াসিনের বোন। বদলায় কেবল স্থান। শিশুদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বাড়ছে ভিক্ষাবৃত্তি।
সমবায় মার্কেটের সামনে প্রায় একইচিত্র দেখা যায়। প্রায় দুই বছর বয়সী একটি শিশুকে শুয়িয়ে রেখেছেন লাকি। কথা হলে তিনি জানান তিনি শিশুর মা। বিগত কয়েক বছর যাবৎ এই শিশুকে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বলে জানান তার পাশের শারীরিক প্রতিবন্ধী একজন ভিক্ষুক।
তিনি বলেন, বাচ্চা ঘুমায় থাকে। প্রায় সময় শিশুকে রেখে ডান্ডি (ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ নামক মাদক জাতীয় বস্তু) খাইতে যায়।
নগরের কেন্দ্রবিন্দু চাষাড়ায় অলিতে গলিতে বেড়েছে ভিক্ষাবৃত্তি। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতে শিশু দিয়ে এরূপ ভিক্ষা ব্যবসার ঘটনা অহরহ দেখতে পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, একদল সংঘবদ্ধ চক্র এই কাজ গুলো করছে। বিকলাঙ্গ শিশুদের সামনে এনে, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে, অসুস্থ শিশু দেখিয়ে ভিক্ষা ব্যবসা চলে। সরাসরি শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করায় আবার কখনো শিশুর মা-বাবা সেজে অপরাধী চক্র ভিক্ষা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
শিশু ভাড়া করে অর্থ উপার্জন করে। প্রতিবন্ধী শিশুদের ভিক্ষার থালা ধরিয়ে দেয়। এভাবেই চলে তাদের প্রতিদিনের উপার্জন।
নগরের ফুটপাতে প্রায় শরীরের তুলনায় অনেক বড় মাথাবিশিষ্ট শিশুর দেখা মিলে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই সমস্যার নাম হাইড্রোকেফালাস। সুচিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও অহরহ এ ধরনের শিশুকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি ও ব্যবসা করতে দেখা যায়।
এমনি এক শিশুর দেখা মিলে জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রধান ফটকে। মিনারের সামনে একজন নারী বিছানা বিছিয়ে বসে আছে। বিছানায় তার সাথে একটি শিশু শুয়ে আছে। শিশুটির সব ঠিক থাকলেও তার মাথা অতিরিক্ত মাত্রায় বড়।
দুজন নারীর মধ্যে তার মায়ের সাথে কথা বললে তিনি জানান, শিশুর নাম মোবারক। তার বয়স ৮ বছর। তার বাবা আছে। আর বড় তিন বোন। মাথা বড় এছাড়া শরীরে সমস্যা হয় না। কোন সমস্যা না থাকলে কেন এই শিশুকে দেখিয়ে ভিক্ষা করছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমরা গরিব এজন্য ভিক্ষা করা লাগে।
নাম প্রকাশে কয়েকজন ভিক্ষুকের সাথে এই বিষয়ে কথা বললে তারা জানান, বাচ্চা নিয়ে বের হলে মানুষের নজর পড়ে। এইজন্য তারা অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য শিশুকে সাথে নিয়ে নেয়।
নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক এই বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, বহুদিন যাবৎ একটা চক্র ভিক্ষুক বেশে সাধারন মানুষের সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ভিক্ষা ব্যবসা করছে। এইসকল চক্র শিশুদের ব্যবহার করে ভিক্ষা করে। এই ক্ষেত্রে সাধারন মানুষের সচেতন হতে হবে।
এছাড়াও আমাদের প্রশাসনকে এই সকল চক্রের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।